বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

জেসিমিন আরা বেগমের গল্প

বাঁশবুনিয়া গ্রাম থেকে পটুয়াখালী শহর (পাঁচ )

রোববার, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২১
বাঁশবুনিয়া গ্রাম থেকে পটুয়াখালী শহর (পাঁচ )


একটি দুর্ঘটনা, সারা জীবনের যন্ত্রণা
আফসার উদ্দিন হাওলাদার তাঁর ৪ বছর বয়সি নাতিকে কোলে বসিয়ে হাট থেকে কিনে আনা দানাদার আর আমৃত্তি খাওয়াচ্ছেন। একমাত্র নাতিটি তার খুবই আদরের, চোখের মনি। সারাক্ষণ কোলে কাঁখে নিয়ে ঘুরে বেড়ান। নাতি দেখতে হয়েছে খুবই সুন্দর, যেন বাবা মা দুজনের রূপ একসঙ্গে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে সে। তার বুদ্ধিও হয়েছে প্রখর। দাদুকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখে এটা কি, ওটা কি প্রশ্ন করে। দাদু মুখে মুখে তাকে ক, খ, অ, আ শেখাচ্ছেন।
হাওলাদারের বড় মেয়ের ঘরে তাঁর প্রথম নাতনী ফাতেমা যদিও আছে, কিন্তু মেয়ের ঘরের মেয়ে তো পরের বাড়ির সদস্য। আর তাছাড়া মেয়ে পেলে লাভ কি? কিছুদিন পরে পরের ঘরে গিয়ে পরের ঘর আলো করবে। তার দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, ছোট মেয়েকেও দ্রুত বিয়ে দেয়ার চিন্তাভাবনা আছে। এদিকে তাঁর বড় ছেলের প্রথম ছেলের পরে পর পর দুই মেয়ে, তাঁর মনে হচ্ছে মেয়ে দিয়ে ঘর ভর্তি হয়ে যাচ্ছে।
নাতি খেতে খেতে হাত আর মুখ মিষ্টির রসে মাখামাখি করে ফেলেছে, তিনি তাঁর পুত্রবধূকে ডেকে বললেন, 'মেরধার ঝি, এক জগ পানি দেও, ওর মুক ধোয়াইয়া দি'।
তিনি বারান্দার এক কোনায় বসে নাতির মুখ ধুইয়ে দিলেন। তাঁর পুত্রবধূটিকে তিনি খুব পছন্দ করেন, যেমন সুন্দরী, তেমন বুদ্ধিমতী। এ সংসারে এসে শাশুড়ির কাছ থেকে সব কাজ গুছিয়ে করতে শিখে গেছে। বউ ঘরে আসার পরে সংসারে ভালোই আয় উন্নতি হচ্ছে।
তবে তাঁর বড় ছেলের উপরে তিনি একটু অসন্তুষ্ট। তাঁর লেখাপড়াই শেষ হয় না। এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিন ছেলেমেয়ের বাবা হয়ে বসে আছে, আয় রোজগারের কোন চেষ্টা করছে না। তিনি মনে মনে ভাবেন শিশু বয়সে বিয়ে দেয়াটাই মনে হয় ভুল হয়েছে।
একদিন তিনি তাঁর বড় ছেলেকে ডেকে বললেন, 'তোমার বিশাল পরিবারের বোঝা আমি আর টানতে পারব না। তুমি এবার চাকরি বাকরির বাবস্থা করে নিজের পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নাও'।
বাবার কথা শুনে ছেলের মন খারাপ হলেও মেনে নিয়ে বলল, 'ঠিক আছে বাজান'।
বাজানকে দেয়া কথা রাখতে পুত্র আমজেদ পড়ালেখার পাট চুকিয়ে দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি নিলো। সেই চাকরিতে বাড়ি থেকে অনেক দূরে দূরে পোস্টিং হয়। সে স্ত্রী পুত্র কন্যা বাবা মায়ের কাছে রেখে, চাকুরিস্থলে লজিং থাকে।
বছর দুয়েক পরে পুত্রবধূ মেহের নেগার আরো একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিলো। হাওলাদার এবার বেশ খুশি। সবাইকে ডেকে বললেন, 'ঘরডা পুরাণ অইয়া গ্যাছে, একটা নতুন ঘর বানাইতে চাই। বড় কইররা, দোতলা। বড় ঘরের দরকার আছে, তোমরা দুই ভাই যেন পরিবার নিয়া আরামে থাকতে পারো'।
সবাই রাজি হলো। দূর থেকে মিস্ত্রি আনা হলো, সেগুণ কাঠ সংগ্রহ করা হলো ঘরের জন্য। মনের মাধুরী মিশিয়ে চারিদিকে বারান্দা আর দোতলায় ঝুল বারান্দা দিয়ে কাঠ আর টিনের বিশাল এক ঘর বানানো হলো। এমন সুন্দর কাঠের কারুকার্য করা ঘর আর দুই চার গ্রামে নেই। যথাসময়ে ঘর বানানো শেষ হলে একদিন মিলাদ দিয়ে ঘরে ওঠা হলো। কিন্তু মিলাদে বা অন্য কোথাও কি কোন খাদ ছিল? নাহলে এমন মর্মান্তিক ঘটনা কেন ঘটল?
একদিন সন্ধ্যার পরে মেহের নেগা তার ছোট ছেলেকে ঘুম পারাচ্ছিল দোতলায়। হঠাৎ ওর শাশুড়ি নিচ থেকে ডেকে বললেন, 'মেরধার ঝি রাইতের খাওয়া দেও'।
শিশুটি ঘুমিয়ে গেছে। মেহের নেগা আস্তে আস্তে বাচ্চার পাশ থেক উঠে সিঁড়ির মুখের দিকে রওয়ানা হল। হ্যারিকেনটা ডিম করা, ওটা আর নিলো না। নিচ থেকে সিঁড়ির মুখে আলো আসছে দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না। সিঁড়ির মুখের কাছে পাটাতনের একটা কাঠ আলগা হয়ে আছে, কেমন করে কে জানে! মেহের নেগা ওই পাটাতনের মাথায় পারা দেয়া মাত্রই উল্টে পড়ে গেলো সোজা নিচে। সিঁড়ির নিচে ঠিক ওখানটাতেই মোটা একটা সেগুণ কাঠের খুঁটির সাথে জোরে ধাক্কা খেলো কোমরে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই ছুটে এলো। ডাক্তার কবিরাজ, গাছের ছাল, পাতা, শিকড়ের রস, পানি পড়া, দোয়া কালাম সব করা হলো। কিন্তু মেহের নেগা পুরা সুস্থ হলো না। জীবনভর এই ব্যথায় কষ্ট পেয়েছে। ব্যথাটা মনে হয় জোয়ার ভাটার মত আসা যাওয়া করত। এই অবস্থায় সংসারের যাবতীয় কাজ এবং আরো ৬ টি সন্তানের জন্ম দিয়েছে।
যেই শিশুটিকে ঘুম পাড়াচ্ছিল, সেই শিশুটি বড় হয়ে যখন বরিশাল মেডিকেল কলেজে পড়তে গেলো, তখন দুর্ঘটনা ঘটার ১৯-২০ বছর পরে তাকে ভালো ডাক্তার দেখানো হলো বরিশালে নিয়ে। ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মেরুদণ্ডের নিচের কোমরের একটা হাড় ভেঙ্গে, এক অংশ অন্য অংশের উপরে উঠে গেছে। বোন টিবি হয়ে গেছে। অপারেশন করলে পুরা ভালো হতে পারে, কিন্তু রিস্কি। এর পরে ঢাকা এবং বরিশালে অনেক চিকিৎসা করা হয়।
১৯৪৯-৫০ সালের দিকে দুর্ঘটনা ঘটে আর ১৯৯৬ সালে মা মারা যান। দীর্ঘ ৪৫-৪৬ বছর এই ব্যথা সহ্য করার কষ্ট কেমন জানি না। মা কি জিনিস নিজে মা হওয়ার আগে মনে হয় ঠিক ভালভাবে অনুধাবন করিনি। একইভাবে ওই ব্যথা সহ্য করার কষ্ট কেমন, নিজে ব্যথা না পেলে ঠিক বুঝব বলে মনে হয় না।

লেখক পরিচিতি :

জেসমিন আরা বেগম, 
কেমিকৌশলী, ১৩ তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য এবং বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। 
প্রাক্তন উপ-পরিচালক,  বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, (বিপিএটিসি)।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল