ডা. রাসেল চৌধুরী :
১৯৭১ সালে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশিকে ভারত আশ্রয় দিয়েছিলো। এই মানুষগুলোর মাঝে আওয়ামী লীগ সহ প্রায় সব মুক্তিকামী দলের শীর্ষনেতারাও ছিলেন।
এই নেতাদের মধ্যে সকল বিষয়ে ঐক্যমত্য ছিলো না। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের মাঝেও বিরোধ ছিলো। এমনকি তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক ছিলেন প্রবলভাবে আপোষকামী, আমেরিকাপন্থী। এমনকি তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রীত্বও আওয়ামী লীগের শীর্ষমহলের সর্বজনীন সিদ্ধান্ত ছিলো না।
বিরোধ ছিলো মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনীর তরুণ নেতাদেরও মাঝে। কমিউনিস্টরাও ছিলেন দ্বিধাবিভক্ত। সেনাবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারদেরও মধ্যেও মতে বিরোধ ছিলো। এমনকি সেনাপতি ওসমানীর নেতৃত্বও প্রশ্নাতীত ছিলো না।
কিন্তু ভারতের ইন্দিরা সরকার এই সকল বিরোধকে কেন্দ্র করে কোনো অরাজকতা তৈরি হতে হয়নি। দক্ষতার সাথে সবাইকে সামলেছিলো। কাউকেই এই সকল মতবিরোধকে কেন্দ্র করে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো পরিণতি ভোগ করতে হয়নি। সেজন্যই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন এত দ্রুত বিজয় অর্জনের সফল রূপ পেয়েছিলো। কারণ ভারত বুঝেছিলো, বাংলাদেশের স্বাধীন ভূখণ্ড পেতে হলে, আমাদের নেতাদেরই শেষ পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে সর্বাগ্রে থাকতে হবে।
আমাদের দেশে মিয়ানমার থেকে বাস্তচ্যুত প্রায় ১০ লাখ রোহিংগা আছে দীর্ঘদিন ধরে। সকল দিক দিয়ে পশ্চাৎপদ এই জনগোষ্ঠীর প্রায় কোনো ক্যারিশমাটিক নেতাই ছিলো না। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন আরাকান রোহিংগা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ।
কক্সবাজারের কুতুপালং শিবিরে তিনি রোহিংগাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করছিলেন। এমনকি এই দাবি নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দপ্তরেও। কিন্তু তিনি অন্য অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের মতো আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেননি। ফিরে এসে কাজ করছিলেন রোহিংগাদের নিয়ে মায়ানমারে ফিরে যাবার জন্য।
আমাদের নিজেদের স্বার্থেই উচিৎ ছিলো মুহিবুল্লাহকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয়া। তাই সেনাবাহিনীসহ সকল আইনশৃংখলা বাহিনীর সুরক্ষাবলয়ে থাকা কুতুপালং ক্যাম্পের ভেতরে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। আগে থেকেই নিরাপত্তা হুমকিতে থাকা এই শীর্ষ রোহিংগা নেতার ক্যাম্পের ভেতরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার ঘটনা আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সক্ষমতা ভীষণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিশেষ করে সেই সময় যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে।
আরেকজন মুহিবুল্লাহ তৈরি হতে সময় লাগবে অনেকদিন। মনে রাখতে হবে, রোহিংগাদের নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বের উত্থান ও বিকাশ লাভ না করলে তাঁদের ফেরত পাঠানো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।
তাই প্রত্যাবর্তনকামী রোহিংগা সংগঠন ও নেতাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও সহায়তা দিন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত শুধু আমাদের পক্ষে বহির্বিশ্বে প্রচারনাই চালায়নি, মোকাবেলা করেছে আমেরিকা ও চীনের মতো মহাশক্তিধর দেশগুলোর হুমকি। নিরাপত্তা দিয়েছে আমাদের ১ কোটি শরনার্থী ও আমাদের নেতাদের।
আসুন রোহিংগাদের কেবল উচ্ছিষ্ট না ভেবে তাঁদেরও ফিরে যাওয়ার জন্য সংগঠিত হতে সাহায্য করি, তাঁদের নেতাদেরও সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিই, যেমনটি আমরা পেয়েছিলাম ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে।
আমাদের গণমাধ্যম ছোট্ট নিউজ করেই দায় সেরেছে। নাসিরের বউ বৈধ কি অবৈধ সেটাই তাঁদের কাছে মুখ্য, রোহিংগাদের ফিরে যাওয়ার সংগ্রামের প্রধান নেতার অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু আজ তাই অনেকটাই আড়াল হয়ে গেছে।
আচ্ছা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাতের ঘটনা ছাড়া মুহিবুল্লাহর কোনো সাক্ষাৎকার, পরিকল্পনা এদেশের প্রধান গণমাধ্যমগুলোতে কখনো এসেছে কি? রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন তিনি? তারপরও আমরা আশা করি রোহিংগারা দ্রুত ফিরে যাবে?
না, বরং নেতার অভাবে, নেতৃত্বের অভাবে পরজীবির মতো রোহিংগারা ছড়িয়ে পড়বে সারা বাংলাদেশে। সেজন্য দায়ী থাকবো আমরাই।