সাইফুল ইসলাম :
কবিতা শিল্পের সুন্দরতম মাধ্যম। কবিতা হৃদয়ের নিগূঢ়তম কথামালার বিশুদ্ধতম প্রকাশ। পৃথিবীতে কবি হয়ে উঠতে চেয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা ধারণাতীত অসংখ্য। আধুনিক সমাজে কবিতার চর্চাও কোনোকালের চেয়ে কম নয়। যারা কবি হতে চেয়েছেন তাঁদের কেউ কেউ কবি, কেউবা অকবি। তাঁদের কেউ কবিতার শব্দচয়ন, বিন্যাস, রূপক ব্যবহারে নিপুন শিল্পীর মতো; আবার কেউ কেউ উদাসীন। ইদানীংকালে যেসব কবির লেখা কবিতার বই আমার হাতে এসেছে তার মধ্যে কবি মিজহারুল ইসলামের এ যাবতকালে প্রকাশিত 'মৃন্ময়ী' ও ' অবাক জোছনা' বই দুটির কবিতাগুলোকে বিশুদ্ধতম কবিতা মনে হয়েছে।
এবার বলি কবি মিজহারুল ইসলামের কবিতাগুলোকে কেন বিশুদ্ধ মনে হয়েছে আমার এ বিষয়ে। কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'অবাক জোছনা'র ভূমিকায় আহসান হাবিব বলেছেন,''আসলে কবিতা লেখা অনেক কঠিন কাজ, আর ছন্দের কবিতা তো মনে হয় আরো কঠিন। সেই কঠিন কাজটাই করে চলেছেন মিজহারুল ইসলাম। তার বেশ কিছু কবিতা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ছন্দবদ্ধ চমৎকার সব কবিতা। তার কবিতায় দেশপ্রেম ও প্রকৃতির কথা বারবার উঠে এসেছে।'
একজন পাঠক হিসেবে আমি আরও বেশি বিমুগ্ধ। কবি মিজহারুল ইসলামের কবিতায় ছন্দের যে কারুকাজ, প্রাকৃতিক উপাদানের যে ব্যবহার, উপমা আর উৎপ্রেক্ষার যে ক্লাসিক্যাল সংযোজন তা আজকাল সহজে চোখে পড়ে না। তাঁর প্রথম কবিতার বইয়ে সূচনা কবিতা 'নকশিকাঁথার আয়না' কবিতায় কবি আবহমান ঐতিহ্যের এক ছান্দসিক উপস্হাপন করেছেন-
" পান মুখেতে গুনগুনিয়ে গান ধরেছে কেউ/
নকশিকাঁথার হাজার স্বপন বুনছে মিয়ার বউ
সোনামুখী সুইয়ের ফোঁড়ে রঙিন সুতো ভরি/
আপন মনে বুনছে কাঁথা আঁকছে সোনার তরী।"
কবিতার প্রতিটি পঙক্তিতে কবি অপূর্ব দক্ষতায় ঘটনা বর্ণনার উপলক্ষ্যে বাংলার রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিতার কোথাও ছন্দের ব্যত্যয় ঘটেনি, যথাশব্দের ব্যবহারও অনন্যতার দাবিদার।
'মৃন্ময়ী' কাব্যগ্রন্থটিতে প্রকাশিত প্রতিটি কবিতাতেই কবি সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিষয় হিসেবে কবি কখনো বেছে নিয়েছেন পরিবেশ প্রতিবেশকে, কখনোবা কবিতার উপজীব্য হয়েছে স্বদেশ কিংবা জীবিত মানুষ আর তাদের যাপিত জীবন। কবি তাঁর 'বাংলাদেশ' কবিতায় স্বদেশের বিজয়কে যে অতুলনীয় ছন্দ- ভাষায় প্রকাশ করেছেন তা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য,
"বিজয় তুমি রক্তসাগর পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত বাংলার পরশ/
বিজয় তুমি জাহান্নামে খেলা শেষে পাওয়া খোদার আরশ।"
কবি তার কবিতাগুলোতে কেবল প্রকৃতি আর মানুষের বন্দনা করেননি। সমাজসচেতন কবি লিখেছেন শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর বিক্ষুদ্ধ চেতনার কথা। তাঁর সমাজ জ্ঞান, বৃথাই কায়িক শ্রম, উল্টো রাজা, উল্টো প্রজা কবিতায় আমার তাঁর সমাজ সচেতন, সংগ্রামী চেতনার প্রকাশও দেখতে পাই।
তাঁর 'পাগলীটাও মা হলো' কবিতায় ঘটনা পরম্পরায় সমাজের দুষ্ট ক্ষতকে উপস্থাপনের যে প্রয়াস তাতে তাঁকে কেবল প্রকৃতি আশ্রয়ী কবিতার কবি অভিধায় আখ্যায়িত করার অপপ্রয়াস বৃথা বলে মনে হবে। তিনি একাধারে মাটি ও মানুষের কবি।
কবির দ্বিতীয় কবিতার বই অবাক জোছনায় কবিকে আরও খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দেখি আমরা। অবাক জোছনা'র প্রথম কবিতায় কবি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে কবিতাটি লিখেছেন তাতে তাঁকে প্রকৃতি আশ্রয়ী কবির চেয়ে সমাজ আশ্রয়ী কবি বলেই বেশি বোধ হয়। কবিতায় তিনি লিখেছেন,
"তখন তোমার প্রতীক্ষায় পুরো জাতি নিশ্চুপপাখিদের কলরব/
কন্ঠে তোমার বজ্রধ্বনি ময়দানে ময়দানে মিছিলের উৎসব।"
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা টেক্সট সংস্করণগুলোর সাথে এ কবিতাটিও সংযোজিত হওয়ার দাবিদার।
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্হে কবিকে আরও বেশি পরিপূর্ণ মনে হলেও তিনি নিজ ঘরানা থেকে বিচ্যূত হননি। তাঁর অবাক জোছনা, জোছনার সংকেত, আষাঢ়, কোকিল, মায়াবতী কবিতাগুলোতে তিনি যে ছন্দ ও শব্দের মায়াজাল সৃষ্টি করেছেন তাতে পাঠকমাত্রই আপ্লুত হতে বাধ্য। তিনি দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্হে লৌকিক ছন্দ ও চাপল্যের বিপরীতে একটা সহজ মনলোভা আবেশী ছন্দ-শব্দের আশ্রয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতা কোঁড়ক। কবিতাগুলো পাঠে যে পারিজাত সোহাগের সৃষ্টি হয় হৃদয়ে করোটিতে তার সৌরভ গাঁথা থাকে। তাঁর শিরোনাম কবিতায় অবাক জোছনার প্রতিটি পঙক্তিতে যে রূপ সুষমা ছড়িয়ে আছে তার থেকে কোনটিকে এ স্বল্প পরিসরে উদ্ধৃত করবো তার সিদ্ধান্ত নেয়া দুষ্কর। যেমন, তিনি লিখেছেন,
"মেঘের কাছে চাওয়া আমার বৃষ্টি দেওয়ার ক্ষণ/
দৃপ্তচারী ঘোলটে মেঘের শুধুই চলার পণ।"
কিংবা শেষ পঙক্তিতে লিখেছেন,
পুণ্য আমার রাতের শরীর অবাক জোছনার ভিড়/
শুদ্ধ হতে বিশুদ্ধ জল চাইনা পৃথিবীর।"
সবমিলিয়ে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে কবি যে ভাবমগ্নতার আবেশ উপহার দিয়েছেন, যে লোকজ ভাষা ও ছন্দের ব্যবহার করেছেন তাতে সহজেই অনুমান করা যায় কবি মিজহারুল ইসলাম হারিয়ে যাবেন না, সহজে হারিয়ে যাবার কবি তিনি নন। যারা কবিতায় মৌলিকতা ধরে রাখার পক্ষপাতী এমন পাঠক-বোদ্ধাদের কাছে তিনি আদৃত থেকে যাবেন, আরাধ্য থেকে যাবেন কালে কালে।