রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

ফসলে ভারী ধাতু এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি : বৈশ্বিক গবেষণা

সোমবার, অক্টোবর ২৫, ২০২১
ফসলে ভারী ধাতু এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি : বৈশ্বিক গবেষণা

ড. মো. সহিদুজ্জামান :

পরিমাণগত এবং গুণগত টেকসই উন্নয়নের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার অগ্রাধিকার সবার ওপরে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অপ্রত্যাশিতভাবে দূষণ বেড়ে যাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে ফসলের গুণগত মানের ওপর। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা এবং মানবস্বাস্থ্য আজ হুমকির মুখে। এই অপ্রত্যাশিত দূষকগুলোর মধ্যে ভারী ধাতু অন্যতম। প্রকৃতিতে পাওয়া প্রায় সব ভারী ধাতুই মাত্রাভেদে বিষাক্ত হয় এবং এসব ধাতু মানব বিপাকে সমস্যা সৃষ্টি করে, যার দরুন রোগাক্রান্ত হওয়ার হার এবং মৃত্যুহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ভারী ধাতব দূষণ পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, যা পরিবেশ এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এই সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নগরায়ণ, অযাচিত সম্পদ ও ভূমি ব্যবহার এবং শিল্পায়ন। শিল্প বিপ্লব এবং বিশ্বায়নের পর থেকে পরিবেশে দূষিত পদার্থের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এটিএসডিআর সংস্থা—বিপাক এবং অন্যান্য জৈবিক কার্যাবলির দিককে কেন্দ্র করে শীর্ষ ২০ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বেশ কয়েকটি বিপজ্জনক ভারী ধাতু। ভারী ধাতুগুলোর মধ্যে রয়েছে মার্কারি, আর্সেনিক, লেড, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি।

 কোথা থেকে আসছে এসব ভারী ধাতু?

বর্তমানে বিভিন্ন উৎস থেকে ভারী ধাতু নির্গত হচ্ছে এবং এসব ধাতু পরিবেশের উপাদানের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কৃষিনির্ভর দেশে ফসল উৎপাদনের প্রধান মাধ্যম মাটি; কিন্তু বিভিন্ন উৎস থেকে আসা ভারী ধাতু এবং ধাতব পদাথর্, যেমন—লেড, কপার, জিংক, নিকেল, ক্যাডমিয়াম, মার্কারি, কোবাল্ট, স্টিবিয়াম, টিন ইত্যাদি মাটিকে দূষিত করছে। মাটির পরিবেশ এবং ভারী ধাতবগুলোর প্রাথমিক উৎস কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদান, পশু-পাখির অপচনশীল অংশ, দূষিত পানি দ্বারা সেচ, ধাতব কীটনাশক, ফসফেট-উপাদানসমৃদ্ধ সার, নর্দমার বর্জ্য ইত্যাদি। প্রাকৃতিক উৎস ছাড়া মানবসৃষ্ট, কারণ যেমন—জীবাশ্ম জ্বালানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত না করার দরুন ভারী ধাতু দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে। গবেষকদের ধারণা, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রগুলো মার্কারিদূষণের একটি প্রধান উৎস। ক্যাডমিয়াম আসছে রাসায়নিক সার থেকে এবং ক্রোমিয়াম ও সিসা আসছে মূলত শিল্প-কারখানা, ইলেকট্রনিক এবং মেডিক্যাল বর্জ্য থেকে।

এ ছাড়া বৈদ্যুতিক বর্জ্য, বিভিন্ন শক্তি ও জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্র, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কয়লাখনি, বিভিন্ন রাসায়নিক শিল্প, টেক্সটাইল, চামড়াশিল্প, ইলেকট্রপ্লেটিং কারখানা, বর্জ্য পানি পরিশোধনাগার এবং ই-বর্জ্য ইত্যাদি থেকে ভারী ধাতু পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। শিল্প বর্জ্য নিকটস্থ জমি সবচেয়ে বেশি ভারী ধাতু দূষণের শিকার।

গবেষকদের ধারণা, বিভিন্ন উৎস থেকে নির্গত ভারী ধাতু শেষ পর্যন্ত মাটিতে জমা হয়ে খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করছে। শিল্প-কারখানার কাছাকাছি জন্মানো ফসল বা গাছগুলোতে বেশি ভারী ধাতু পাওয়া যায়। এই দূষিত মাটি থেকে উৎপাদিত ফল, ফসল এবং শাক-সবজি গ্যাস্ট্রো-ইনটেস্টাইনাল (অন্ত্রের) ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। মার্কারি দূষিত মাটিতে জন্মানো বিভিন্ন ধরনের সবজি, যেমন—পালংশাক, কলমিশাক, লেটুস এগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বর্তমানে গ্রিনহাউসে জন্মানো শাক-সবজিও ভারী ধাতুর দূষণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। গ্রিনহাউসে উৎপাদিত সবজিতে ভারী ধাতু দূষণের কারণ পর্যাপ্ত যত্ন এবং উপযুক্ত ও বিশুদ্ধ উপাদান বা আলোর অভাব বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন।

স্বাস্থ্যঝুঁকি

পরিবেশগত দূষক—খাদ্য সুরক্ষা এবং মানবস্বাস্থ্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। পরিবেশে ভারী ধাতুগুলোর ঘনত্ব সাম্প্রতিক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষকরা বলছেন, খাদ্যচক্রে রাসায়নিক দূষণের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে, যা মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

অনেক সময় ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, পারদ ও সিসার অধিক ব্যবহার ও এদের কিছু রাসায়নিক গঠন প্রাণীতে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ—ষড়যোজী ক্যাডমিয়াম, পারদ বাষ্প, যা ফুসফুস বিকল করে দিতে পারে। ক্রোমিয়াম  (VI) ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী, ক্যাডমিয়াম হাড়ের রোগ সৃষ্টি করে, পারদ ও সিসা কেন্দ্রীয় স্নায়ুুতন্ত্রে ক্ষতি করে। এই ধাতুগুলো পানি, মাটি এবং খাদ্যদ্রব্যে সরাসরি প্রবেশ করে। ফলে গুরুতর মানবস্বাস্থ্যের সমস্যাগুলো যেমন রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস, গ্যাস্ট্রো-ইনটেস্টাইনাল ক্যান্সার, অপুষ্টি দেখা দিতে পারে।

সিসাদূষণ মানসিক বিকাশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে বাচ্চাদের মধ্যে নিউরোলজিক্যাল এবং কার্ডিওভাসকুুলার রোগের সৃষ্টি করে। কিছু ভারী ধাতব যেমন—লেড, ক্যাডমিয়ামের কারসিনোজেনিক প্রভাব রয়েছে এবং এগুলো হাড় ভাঙা এবং ক্ষয়রোগ, কার্ডিওভাসকুলার জটিলতা, কিডনি বিকল, হাইপারটেনশন, লিভার, ফুসফুস এবং স্নায়ুুতন্ত্রের অন্যান্য গুরুতর রোগের কারণ হতে পারে।

কিছু কিছু ভারী ধাতু ক্যান্সার তৈরি করে না, যেমন—ক্রোমিয়াম, কপার তবু মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। দেখা দিতে পারে নিউরোলজিক জটিলতা, মাথা ব্যথা এবং লিভারের রোগ। ক্রোমিয়াম  (VI) এবং ক্রোমিয়াম  (III) অন্যান্য আয়নিকের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক এটির স্থায়িত্বের দিক থেকে সর্বোর্ধ্বে। বৈদ্যুতিক বর্জ্য থেকে ছড়ানো ভারী ধাতু মানবদেহে বিষক্রিয়াজনিত প্রভাব ফেলে, যা উঘঅ-কে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে (জেনোটক্সিক), যার দরুন জন্মগত ত্রুটি, জেনেটিক ডিজঅর্ডার, শিশুমৃত্যু এবং স্নায়বিক ত্রুটি দেখা যায়। এই ভারী ধাতুগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ছাড়াও মাটিতে বসবাসকারী বিভিন্ন উপকারী প্রাণীকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে মাটির উর্বরতা এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে।

কিভাবে ভারী ধাতু খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করছে?

উদ্ভিদ শিকড় দিয়ে মাটি থেকে পানি এবং খনিজ পুষ্টি গ্রহণ করে। ভারী ধাতুগুলো পানি এবং খনিজ পুষ্টির সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে এবং পরবর্তী সময়ে আয়ন আকারে স্থানান্তরিত হয়, এ ক্ষেত্রে উদ্ভিদ টিস্যুর জাইলেম ভূমিকা পালন করে। উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ঘনত্বে ভারী ধাতু জমা হতে পারে। সেই উদ্ভিদ বা ফসল গ্রহণ করার ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি হওয়ার উচ্চ সম্ভাবনা থাকে।

প্রতিরোধে করণীয়

উন্নত মানবস্বাস্থ্যের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার লক্ষ্যে ভারী ধাতু দূষণ রোধ করতে হবে। এ জন্য ফসলি জমিতে সেচ, স্ল্যাজ এবং শিল্প-কারখানার বর্জ্যপ্রবাহের ভারী ধাতুর নৃতাত্ত্বিক উৎসগুলো যথাযথ সুব্যবস্থায় আনতে হবে। মাটিতে ভারী ধাতুর দূষণ প্রতিকার রোধে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। ভারী ধাতুর প্রতিকার রোধে পরিবেশগত জৈবিক এবং রাসায়নিক ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ন্যানো টেকনোলজির উদ্ভাবনগুলো সহায়তা করতে পারে। শিল্প-কারখানার বর্জ্য রিসাইকল করার ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন কারখানা থেকে দূরবর্তী স্থানকে কৃষিক্ষেত্র স্থাপন করতে হবে। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে কৃষি খাতে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। ড্রেনে বা পয়োনিষ্কাশনের ময়লা কমাতে হবে। পরিষ্কার পানির দ্বারা সেচ দিতে হবে। রাস্তার পাশে লাগানো ফসল ট্রাফিকের ভারী ধাতু দ্বারা দূষিত হতে পারে। এ জন্য রাস্তার পাশে ফসল লাগানো থেকে বিরত থাকতে হবে।

ফসলি জমিতে বায়োচার প্রয়োগ করতে হবে। বায়োচার একটি শক্তিশালী পরিবেশ-প্রতিকারক হিসেবে বিবেচিত। মাটিতে ভারী ধাতব দূষণ দূরীকরণে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। বায়োচার হলো এক ধরনের চার  (char) বা কয়লা, যা বাতাসের অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে তাপের সাহায্যে উদ্ভিদজাতীয় পদার্থ, যেমন—কাঠ, কাঠের গুঁড়া, আগাছা থেকে তৈরি করা হয়। জমিতে বায়োচার প্রয়োগের মাধ্যমে মাটির উর্বরতাসহ মাটির গুণাগুণ এবং ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। বায়োচার মাটিতে ধাতব ঘনত্ব হ্রাস করে। টেকসই খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষিতে বায়োচার প্রযুক্তির ব্যবহারের ভূমিকা অপরিসীম।

তাই মাটির দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় গবেষণা, এর প্রতিকারে শিল্প-কারখানায় ইটিপি  (Effluent Treatment Plant) স্থাপন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কঠোরভাবে অনুসরণ করা, মাটির গুণাগুণ রক্ষায় রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহারের পরিবর্তে জৈব সার এবং জৈব প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে পরিবেশ থেকে ভারী ধাতুর দূষণ রোধ করে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।

 ছোট-বড় ব্যাটারি, কলকারখানার বর্জ্য, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, হাসপাতাল ও ক্লিনিক বর্জ্য, গবেষণাগারের বর্জ্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক পদ্ধতিতে ডিসপোজাল (বর্জ্য সংরক্ষণ) করতে পারলে যেকোনো দেশ পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে খাদ্য শৃঙ্খলে এসব ক্ষতিকর ভারী ধাতুর প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে গবেষকরা মতামত দেন। বিভিন্ন খাদ্যশস্যে ভারী ধাতুর পরিমাণ এবং মানব শরীরে সহনীয় মাত্রা নির্ণয় করা প্রয়োজন। প্রয়োজন এসব ভারী ধাতু সম্পর্কে কৃষক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে জ্ঞান প্রদান ও সচেতন করা।

[লেখাটি একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ  (Environment International 125, 2019:365–385) থেকে তৈরি এবং সহায়তা করেছেন হালিমা তুজ্জ সাদিয়া]

লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল