ডা. এজাজ বারী চৌধুরী:
মাত্র ২৫ বছর বয়সে ডায়াবেটিস ধরা পড়েছিলো হিমেলের৷ এতো বেশি যে, ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা লেগেছিলো৷ হিমেলের মনে হয়েছিলো, জীবনটাই পুরোপুরি ব্যর্থ এবং অর্থহীন হয়ে গেছে তার৷ অনেকদিন নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো — আত্মবিশ্বাসও পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিলো সে৷
ভার্সিটিতে অনিয়মিত হতে থাকলো, পড়াশুনাতেও দিন দিন পিছিয়ে যেতে থাকলো মেধাবী হিমেল৷ বন্ধুদের সাথে দূরত্বের দেয়ালটাও উঁচু হতে থাকলো ধীরে ধীরে৷ ডায়াবেটিসের কথাটি গোপন রেখেছিলো সে সবার কাছে৷ হিমেলের এই হটাৎ পরিবর্তন বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে তাই বেশ আলোচিত বিষয় হয়ে দাড়িয়েছিলো৷
হিমেলের মা, গোপনে হিমেলের ছোটবেলার বন্ধু, সদ্য পাশ করা ডাক্তার তাসিনকে সব খুলে বললেন এবং অনেক অনুনয় বিনয় করলেন তার ছেলেকে যে করেই হোক স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে৷ ডা. তাসিন কিছুদিন সময় চাইলেন৷
কয়েকবার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর, তাসিন হিমেলকে তার হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলো৷ প্রথমেই ওকে একটি ওয়ার্ডে নিয়ে গেলো, যেখানে কারো হাত, কারো পা কেটে ফেলা হয়েছে, কেউ কেউ অচেতন হয়ে পড়ে আছে৷ তাসিন বললো, দেখ হিমেল, এইসব মানুষগুলো কয়েকঘন্টা বা কয়েকদিন আগেও পুরোপুরি সুস্থ ছিলো৷ রোড এক্সিডেন্টে চোখের পলকে তারা পঙ্গু হয়ে গেছে, কেউ কেউ হয়তো লাশ হয়ে বাড়ি ফিরবে৷ তুই তো এদের থেকে ভাগ্যবান৷ কিছুই হারায়নি তোর - শুধু একটু নিয়ম মেনে চললে আমাদের সবার থেকে তোর জীবন আরো দীর্ঘ হবে, সবার থেকে বেশি সুস্থ থাকবি তুই৷
তাসিন তারপর একে একে হিমেলকে নিয়ে গেলো কিডনী, হার্ট, সার্জারী, নিউরোলজি এবং চক্ষু ইউনিটে৷ প্রত্যেকটা ইউনিটের ভর্তি রোগিদের বড়ো অংশ ডায়াবেটিস আক্রান্ত এবং তাদের ডায়াবেটিস থাকতো অনিয়ন্ত্রিত৷ একজন চাচা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, "বাবা - ডাক্তার স্যারেরা অনেক কইরা কইতো, ডায়াবেটিস বাড়তি থাকলে সামনে অনেক বড়ো বিপদ আইবো - কিন্তু গা করি নাই৷ অহন আমার হার্টে সমস্যা, কিডনী নষ্ট, পায়ে জ্বালাপোড়া, চউক্ষে কম দেহি৷ বউয়ের সাথে মেলামেশাও করতে পারিনা অনেক বছর, জীবনে কুনো সুখই আর নাই৷ অহন ভিটা মাটি বেইচ্যা চিকিৎসা করতাছি৷"
সারাটা দিন চোখ নষ্ট, কিডনী নষ্ট, হার্ট এট্যাক, পায়ে পচন, প্যারালাইসিস এসব রোগিদের সাথে কথা বলতে বলতে জীবনকে নতুনভাবে আবিস্কার করলো হিমেল, ওর ভেতর এক নতুন সত্বার জন্ম নিলো৷
॥ ২৫ বছর পর॥
হিমেলের বাড়িভর্তি সাংবাদিক, টিভি ক্যামেরা আর শত মানুষের ঢল৷ মানুষের ভালোবাসা জড়ানো শত শত ফুলের তোড়ার মৌ মৌ গন্ধে, মনটাতেও অন্যরকম সুখের অনুভূতি৷ হিমেলের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান Hope for Diabetes আজ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছে৷
২৫ বছর আগে, হাসপাতালে ডায়াবেটিস রোগিদের দূর্দশা দেখে জীবনের ব্রত ঠিক করেছিলো হিমেল - "আমরণ সে ডায়াবেটিসের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে৷ নিজে বিজয়ী হবে এবং জয়ের পতাকাতলে আরো লাখো মানুষকে আনবে৷"
আজ হিমেল সফল৷ গুরুত্ব দিলেই ডায়াবেটিসকে জয় করা যায় — এটাই ছিলো তার সফলতার মূলমন্ত্র৷
লেখক : হেড অব ডায়াবেটিস এন্ড হাইপারটেনশন সেন্টার, মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস সেন্টার, ধানমন্ডি, ঢাকা।