গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিস্কারের পর জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে নতুন মেরূকরণ। রাতারাতি বদলে গেছে প্রভাব বলয়ের সব সমীকরণও। নিজের এলাকায় থেকেও হঠাৎই কোণঠাসা ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন দাপটশালী মেয়র জাহাঙ্গীর। পরিস্থিতি বেগতিক দেখার পর দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠজন হিসেবে মেয়রের ছায়া হয়ে থাকা অনেকেই দূরে সরে গেছেন। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন জাহাঙ্গীর ও তার অনুসারীরা।
এদিকে মহানগর আওয়ামী লীগে মেয়রপন্থি হিসেবে পরিচিতরা এ ঘটনায় রয়েছেন কিছুটা বিপাকে। অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরের কারণে অনেক দিন কোণঠাসা হয়ে থাকা নেতাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে উচ্ছ্বাস। সব মিলিয়ে বদলে গেছে গাজীপুরের রাজনীতির প্রেক্ষাপট। সেখানে এখন এক ধরনের নতুন হাওয়া বইছে। সরেজমিন গাজীপুর ঘুরে একাধিক নেতা ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে পরিবর্তনের এমন আবহ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে কটূক্তি করায় ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগ থেকে জাহাঙ্গীর আলমের প্রাথমিক সদস্যপদ আজীবনের জন্য বাতিল করা হয়। তিনি গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
এদিকে গতকাল রোববার সন্ধ্যার পর থেকে গুঞ্জন ছড়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জাহাঙ্গীরকে আটক করেছে। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এ ধরনের কিছু ঘটেনি। মেয়রকে এক ধরনের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যে কোনো সময় তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হতে পারে। দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, মেয়রকে অভিযুক্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হতে পারে।
গাজীপুরের একাধিক নেতা জানান, মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি ৭১ সদস্যের। ২০১৬ সালে এই কমিটি গঠন করা হয়েছিল। একজন কেন্দ্রীয় নেতার আশীর্বাদে বয়সে তরুণ জাহাঙ্গীর আলম সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়েছিলেন। এর পরই তার ভাগ্যের চাকা চরকির মতো ঘুরতে থাকে। দুই বছরের মাথায় দলীয় মনোনয়ন পেয়ে গাজীপুরের মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। মহানগর কমিটির সদস্যদের মধ্যে ১৫-২০ জন মেয়রের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। তাদের মধ্যে রয়েছেন মহানগর সাংগঠনিক সম্পাদক মুজিবর রহমান ওরফে বেনসন মুজিব, যুগ্ম সম্পাদক মোকশেদ আলম, ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুর রব নয়ন, আমজাদ হোসেন বাবুল ও দপ্তর সম্পাদক মনির হোসেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, সংগঠন থেকে জাহাঙ্গীরকে বহিস্কারের পর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে আসার কথা এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের। তবে রাজনীতির মাঠে আছে অন্য গুঞ্জনও। কারও কারও ভাষ্য, তিন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মধ্য থেকে যে কাউকেই ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হতে পারে। জাহাঙ্গীরের স্থলাভিষিক্ত কাকে করা হবে- এই সিদ্ধান্তের জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের দিকে তাকিয়ে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা বলছেন, কেন্দ্র থেকে সিদ্ধান্ত না এলে তাদের পরামর্শ ও দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাধারণ সম্পাদক বেছে নেওয়া হবে। গত দু'দিন গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী শূন্যপদ পূরণ করা হবে। এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকেরই ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হওয়ার কথা। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারাও সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। আমরা তা জানার অপেক্ষা করছি।
মহানগর আওয়ামী লীগের এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হলেন আতাউল্লা মণ্ডল। দুই নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মতি। তিন নম্বর হলেন মোকশেদ আলম। এদের মধ্যে প্রথম দু'জন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। রাসেলের আপন চাচা মতি। তৃতীয়জন হলেন মেয়রপন্থি। আর আতাউল্লা মণ্ডল অনেক দিন ধরে অসুস্থ।
দীর্ঘদিন রাজনীতি করছেন এমন একাধিক নেতা জানান, গাজীপুর আওয়ামী লীগের অন্যতম দুর্গ হিসেবে পরিচিত। গাজীপুরের মাটি থেকে উঠে এসেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতির অনেক বড় নেতা-সংগঠক। দেশ গড়ায় যাদের অবদান অপরিসীম। বর্তমান মন্ত্রিসভায়ও গাজীপুরের দু'জন এমপি রয়েছেন। কিছুদিন ধরেই এলাকার রাজনীতিতে তিনটি মেরূকরণ ক্রমেই প্রতিভাত হয়ে উঠছিল। এক মেরুর কেন্দ্রে রয়েছেন জাহাঙ্গীর। অন্য দুই মেরুতে আছেন আজমত উল্লা খান এবং জাহিদ আহসান রাসেল। সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটি দেওয়াকে কেন্দ্র করে জাহিদ আহসান রাসেলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় জাহাঙ্গীর আলমের। আহ্বায়ক কমিটিতে জাহাঙ্গীর তার অনুসারীদের প্রাধান্য দেন। গাজীপুরের ঠিকাদারি কাজও তার ঘনিষ্ঠ লোকজনই বেশি পেয়েছেন। প্রতিমন্ত্রীর লোকজন পদবঞ্চিত হন। সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারি কাজ পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হন আজমত ও রাসেলের ঘনিষ্ঠরা।
জানা যায়, মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আজমত উল্লা খানের সঙ্গে বাহ্যিকভাবে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন জাহাঙ্গীর। যদিও আজমত উল্লার বাসস্থান টঙ্গী পূর্ব এলাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থেকেছেন। এ নিয়ে দু'জনের মধ্যে ভেতরে ভেতরে দূরত্ব বাড়তে থাকে। সেই সূত্রে ধীরে ধীরে রাসেল ও আজমত উল্লার মধ্যে বোঝাপড়া দৃঢ় হয়ে ওঠে।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আজমত উল্লা বলেন, মেয়র জাহাঙ্গীর আলম এখন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। ঝড়ের বেগে যে আসে, ঝড়ের বেগে তার পতন হয়। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা তার কর্মকাণ্ডে হতাশ ছিলেন। তাদের যথাযথ মূল্যায়ন সে করেনি। দলে বিভাজন তৈরি করেছিল। সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করত। বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত ছিল তার। জাহাঙ্গীরকে বহিস্কারের ফলে গাজীপুরে দল আরও সুসংহত ও শক্তিশালী হবে।
এদিকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত জাহাঙ্গীর আলম তার গাজীপুরের বাসায় ছিলেন। তবে মেয়রের বাসার ভেতরের দৃশ্য ছিল ভিন্ন। সব সময় মেয়রের বাড়ি ঘিরে শত শত নেতাকর্মীর জটলা থাকলেও গতকাল ছিল ব্যতিক্রম। অল্পসংখ্যক যারা সেখানে ছিলেন, তাদের সঙ্গেও মেয়র দেখা করেননি। এ ছাড়া অভিযান আতঙ্কে মেয়রের বাড়ির সীমানা প্রাচীরের ভেতরে থাকা সিটি করপোরেশনের গাড়ি ও সব মালপত্র সিটি করপোরেশন ভবনে গতকাল সরিয়ে নেওয়া হয়। দুপুরের পর তিনি বাসা থেকে বের হন। তার একাধিক ঘনিষ্ঠজন জানান, তিনি ঢাকার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়েছেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল্লাহ আল মামুন মণ্ডল বলেন, আরও আগেই মেয়রকে বহিস্কার করলে দলের জন্য ভালো হতো। তৃণমূল পর্যায়ে গাজীপুরে আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান। নতুন কে দায়িত্ব পাবে, এটা এখন দেখার বিষয়।
সময় জার্নাল/এসএ