কামরুল হাসান:
‘সোনার গয়নায় খাঁটি সোনা নেই’- শিরোনামে জনকণ্ঠে একটি সিরিজ রিপোর্ট করে পুরস্কার পেয়েছিলাম । সেই রিপোর্টের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে দিয়েছিলেন আলতু ভাই (মোয়াজ্জেম হোসেন, বিবিসি বাংলা- লন্ডনের নাম করা সাংবাদিক)। পরিকল্পনা মতো তথ্য জোগাড়ের জন্য গেলাম বায়তুল মোকাররমে এক সোনা ব্যবসায়ীর কাছে। সে সময়ে তিনি ছিলেন সোনা পাচারকারীদের রিং লিডার। বিশাল জুয়েলারি ব্যবসা তাঁর, কথা বলছিলাম সেখানে বসে।
তাঁর সম্পর্কে আগে থেকেই সব তথ্য আমার কাছে ছিল। কথা বলতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারছিলেন ফেঁসে যাচ্ছেন। এক পর্যায়ে খুব রেগে গেলেন, আমাকে একটি রুমে নিয়ে আটকে দিলেন। এরপর দরজা বন্ধ করে বাইরে চলে গেলেন। তখন মোবাইল ফোন ছিল না, রুমে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো পথ নেই। ঘণ্টা দুয়েক পর তিনি নিজে এসে দরজা খুলে মুক্ত করে দিলেন। আর ভয় দেখিয়ে বলেন, ‘নিউজ হলে তোর খবর আছে’ ।
সে সময়ে জনকণ্ঠে ‘রিপোর্টারের ডায়েরি’ ছাপা হতো । তাতে থাকতো খবরের পেছনের গল্প। আমিও কারও নাম উল্লেখ না করে আমি সেই ‘আটকে পড়া’র গল্পটা লিখে দিলাম । ছাপা হওয়ার পর দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ আমাকে ডেকে পাঠালেন। ঘটনা শুনতে চাইলেন। সব শুনে বকাঝকা করলেন, বললেন এ ঘটনা আগে কেন তাঁকে বলিনি।
বিকাল বেলা অফিসে ঢুকতে শুনি সম্পাদক আবার ডেকেছেন। তিনি যে তলায় বসতেন সেখানে গিয়ে দেখি সেই সোনার ব্যবসায়ী বসে আছেন। সম্পাদক তাঁকে ডেকে এনে বসিয়ে রেখেছেন। আমাকে সামনে পেয়ে সোনার ব্যবসায়ীর কাছে আটকে রাখার কারণ জানতে চাইলেন। অতবড় ব্যবসায়ী কিছু না বলে শুধু ‘ভুল হয়েছে’ বলে সম্পাদককে বললেন । কিন্তু সম্পাদক তাতে খুশি নন। তিনি বললেন, আমার রিপোর্টারের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এবার ব্যবসায়ী পড়লেন বিপাকে। কিন্তু সম্পাদক নাছোড়। শেষ পর্যন্ত আমার হাত ধরে তাঁকে ক্ষমা চাইতেই হলো।
আমার মতো সাধারণ মানের একজন স্টাফ রিপোর্টারের জন্য সম্পাদক যা করলেন, তাতে আমার চোখে পানি এলো। আমার কান্না দেখে আদুরে বকা দিয়ে বললেন, ‘ক্রাইম রিপোর্টিং করতে এসেছে আর মন এত নরম কেন হে? চোখ মোছো । সম্পাদকের বকা খেয়ে চোখ মুছতে মুছতে বাইরে চলে এলাম।
আজ সকালে বন্ধু পারভেজ খান ফোন করে জানালেন, আমার শ্রদ্ধেয় সেই সম্পাদক মারা গেছেন। পারভেজের কথা শুনে আজও আমার চোখ ভিজে এলো। কিন্তু কেউ বকা দিয়ে বললেন না, মন এত নরম কেন হে? চোখ মোছো।
স্যার, আপনি পরপারে ভালো থাকুন।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার