সময় জার্নাল প্রতিবেদক : পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৪ বছর পূর্তি আজ। পাহাড়ে প্রায় দু’যুগের বেশি সময় ধরে সশস্ত্র আন্দোলন চলার পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি। চুক্তির পর খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে শান্তিবাহিনীর শীর্ষ গেরিলা নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) তার বিপুলসংখ্যক সহযোগী নিয়ে অস্ত্র সমর্পণের মধ্য দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। সরকার তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ প্রদান করে। শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে।
শান্তি চুক্তি হলেও ২৪ বছরে শান্তি ফেরেনি সেখানে। পার্বত্যাঞ্চলে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়ই ঘটছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর এ পর্যন্ত ২৪ বছরে পাহাড়ে সশস্ত্র চার গ্রুপের হাতে ৯ শতাধিক খুন হয় এবং ১৫শ’ গুম হয়েছে। গুম হওয়াদের মধ্যে ৬০ ভাগ মুক্তিপণের টাকা দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে। বাকিদের বিভিন্ন জঙ্গলে লাশ ফেলে দেয়া হয়। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। তবে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে কোন অপরাধীর শাস্তি হয়নি। যে সাক্ষ্য দিতে যাবে, তাকে হত্যা করবে। এই কারণে কেউ স্বাক্ষী দিতে চান না। অনেকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছে, কিন্তু সাক্ষীর অভাবে তাদের সাজা হয়নি। রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপার মীর মোদদাছছের হোসেন বলেন, সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে পাহাড়ে কোন অপরাধীর সাজা হয়নি।
সরকার শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে শতভাগ আন্তরিক হলেও এক্ষেত্রে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পাহাড়ের চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন। তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এলাকা এখন জেএসএস (মূল), জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (মূল) ও ইউপিডিএফ (সংস্কার) এই সশস্ত্র চার গ্রুপ টার্গেট করে মূল ধারার রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করছে। আগে চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার ও ভাগবাটোয়া নিয়ে খুনখারাপি হলেও এখন তাদের মূল টার্গেট মূল ধারার রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হত্যা করা। উদ্দেশ্য পাহাড়ে মূল ধারার রাজনৈতিক সংগঠন নির্মূল করা। মূল ধারার রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিলে তাদের আধিপত্য থাকবে না।
পার্বত্য শান্তি চুক্তি
স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা বলেন, এই খুনিদের বিচার না হওয়ায় তারা আরও বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। খুনিরা অস্ত্রসহ ধরা পরলেও বিচার হয় না। যে সাক্ষী দেবে তার মেরে ফেলবে। তাই কেউ সাক্ষী দিতে আসেন না। বেশি চাঁদা আদায় করা হয় নির্মাণ কাজের ঠিকাদার আর দুর্গম এলাকায়। যেখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যেতে পারেন না। পাহাড়ের ব্যবসায়ী ও ছোটখাট দোকানদারসহ সবাই বলেন, আমরা শান্তি চুক্তির পক্ষে। চাঁদাবাজদের হাত থেকে রক্ষা পেতে চাই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান তারা।
পাহাড়ে ১০ বছর আগের হানাহানির শিকার হয়েছেন মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। তবে সম্প্রতি টার্গেট করা হয়েছে মূল ধারার রাজনীতিকদের। বার বার ঝরছে রক্ত। একটি খুনের রেশ না কাটতেই হচ্ছে আরেক খুন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাঙামাটির সদর উপজেলাধীন বন্দুকভাঙ্গায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের গুলিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা আবিষ্কার চাকমা (৪০) নিহত হয়েছেন। এর আগে গত ১৭ অক্টোবর রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চিৎমরম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী নেথোয়াই মারমা (৫৬) দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন। এর আগে শক্তিমান চাকমার মতো একজন উপজেলা চেয়ারম্যান খুন হন। ভূমি যার বেশি, চাঁদা তার বেশি এই আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে সশস্ত্র চার গ্রুপ। শান্তি চুক্তির বাস্তবায়নে তারাই প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত এক বছরে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পজলায় অন্তত ১৬ জন নিহত, অস্ত্রসহ আটক ৩০ ও বিপুল পরিমাণ ভারী মারণাস্ত্রের গুলি, এ কে ২২ রাইফেল, একে-৪৭সহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম উদ্ধার উদ্ধার এবং এলাকা আধিপত্য বিস্তারের জন্য অন্তত ৭/৮ বার গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে পাহাড়ে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এম পি বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির সকল ধারা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির ৭২ ধারার মধ্যে ইতিমধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন চলমান আছে। এদিকে শান্তি চুক্তির ২৪ তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে শোভাযাত্রা বৃহস্পতিবার বান্দরবান রাজার মাঠে পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৪ তম বর্ষপূর্তি উদযাপন উপলক্ষে ৭ ফিল্ড এ্যাম্বুলেন্স এর আয়োজনে ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের ব্যবস্থাপনায় বান্দরবান সেনানিবাসের এমডিএস ভবনে বিনামূল্যে চক্ষুসেবার আয়োজন করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ২৪ বছরপূর্তি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে রাষ্ট্রপতি পার্বত্য জেলাসমূহের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে টেকসই ও বেগবান করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে আরও নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ২৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য এলাকার সকল অধিবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপার আধার। যুগযুগ ধরে পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বর্ণিল জীবনাচার, ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি এ অঞ্চলকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য শান্তি চুক্তি করে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি করেছেন, যা একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার শান্তি চুক্তির আলোকে পার্বত্য অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির দুই যুগ পূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য জেলাসমূহের জনগণ ও দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকার শান্তি চুক্তির আলোকে পার্বত্য অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে জাতির পিতার সুখী-সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।’ বাণীতে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির দুই যুগ পূর্তি উপলক্ষে গৃহীত সকল কর্মসূচির সার্বিক সাফল্য কামনা করেন।
সময় জার্নাল/এসএ