মোঃ আরিফ হোসাইন: সিরামিক শিল্প বাংলাদেশের একটি ক্রমবর্ধমান খাত। বছরের পর বছর ধরে শিল্পটি ব্যাপকভাবে বিকাশ লাভ করেছে। যদিও এটি স্থানীয় চাহিদার ৮৫ শতাংশ পূরণ করে, আন্তর্জাতিক বাজারে মানসম্পন্ন সিরামিক পণ্যও রপ্তানি করে আসছে । একটি পরীসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১০ সালে লোকাল মার্কেট এ সিরামিক এর চাহিদা ছিল ১২.২৫ বিলিয়ন টাকা, ২০২০ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১.৪৫ বিলিয়ন টাকা।
প্রবৃদ্ধির প্রবণতা দেখে বুজা যাচ্ছে, এটি দেশের শীর্ষ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারীদের মধ্যে অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে গড়ে উঠছে।
ইতিহাসঃ
বাংলাদেশের সিরামিক শিল্প 1958 সালে বাগুড়ায় তাজমা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক চীনামাটির বাসন থালাবাসনের জন্য একটি ছোট উৎপাদন কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে, দেশে 60 টিরও বেশি সিরামিক প্রস্তুতকারক রয়েছে। আরও 20টির মত কোম্পানি বাজারে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বর্তমান চিত্রঃ
বাংলাদেশের সিরামিক শিল্প প্রধানত টাইলস, টেবিলওয়্যার এবং স্যানিটারি পণ্য তৈরি করে থাকে। বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (BCMEA) অনুসারে, সিরামিক শিল্পের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে: টেবিলওয়্যার (২৫০মিলিয়ন পিস), টাইলস (১২০ মিলিয়ন বর্গ মিটার) এবং স্যানিটারি ওয়্যার (৭.৫ মিলিয়ন পিস)। সিরামিকের মূল্য সংযোজন প্রায় ৬৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সিরামিক পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশের সব বড় সিরামিক কোম্পানি তাদের প্ল্যান্ট ও কার্যক্রম সম্প্রসারণ করছে। স্থানীয় শিল্পও সক্রিয়ভাবে উন্নত সিরামিক পণ্য যেমন স্পিনিং এবং টেক্সটাইল কারখানার জন্য শিল্প সিরামিক, মেডিকেল সিরামিক, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটের জন্য সিরামিক প্লেট এবং আরও অনেক কিছু তৈরির সম্ভাবনা খোঁজ করছে।
বর্তমানে, ৫০০,০০০ এরও বেশি লোক স্থানীয় সিরামিক শিল্পে নিযুক্ত রয়েছে।এই সেক্টরের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে, দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউটে গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিং (জিসিই) বিভাগ, গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বাজারঃ
বাংলাদেশের সিরামিক শিল্প বিশ্ববাজারে একটি বিশেষ স্থান তৈরি করেছে। বিসিএমইএ অনুসারে, শিল্পটি রপ্তানির মাধ্যমে ৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করে। বিভিন্ন সিরামিক পণ্যের মধ্যে, টেবিলওয়্যার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া সহ ৫০ টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল ভারত, নেপাল এবং ভুটানে টাইলস; এবং মধ্যপ্রাচ্যে স্যানিটারি আইটেম, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বাংলাদেশের সিরামিক রপ্তানির ৯০ শতাংশের বেশি খাবার টেবিলওয়্যার।
চ্যালেঞ্জঃ
সিরামিক শিল্পের বিকাশের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে একটি হল প্রাকৃতিক গ্যাসের অপর্যাপ্ত সরবরাহ। প্রাকৃতিক গ্যাস শুধুমাত্র শিল্পের মূল শক্তির উৎস নয় বরং পণ্যের গুণমান বজায় রাখার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্থানীয় প্রাকৃতিক গ্যাসে কোনো সালফার থাকে না যা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সিরামিক পণ্যকে উজ্জ্বল ও চকচকে দেখায়। যখন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)পুরোপুরি ভাবে চালু হবে তখন সংকট সমাধান হবে বলে আশা করা যায়। এতে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ ও উৎপাদনশীল খাতের ওপর চাপ কমবে এবং বিশেষ করে সিরামিক শিল্প গ্রিড-গ্যাসের সরবরাহ পাবে।
বাংলাদেশে সিরামিক পণ্যের কাঁচামালের ঘাটতি রয়েছে এবং প্রস্তুতকারকরা আমদানি করা কাঁচামালের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তাছাড়া এসব কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ও অগ্রিম আয়করের কারণে সিরামিক কোম্পানিগুলোকে বিপুল পরিমাণ খরচ বহন করতে হচ্ছে। সিরামিক নির্মাতারা কাঁচামাল আমদানিতে শূন্য-শুল্ক সুবিধা এবং পোশাক শিল্পের মতো রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ প্রণোদনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
তারা কাঁচামাল আমদানি এবং তৈরি পণ্য সরবরাহের জন্য দ্রুত ট্র্যাক বন্দর এবং যোগাযোগ সুবিধার বিকাশের জরুরি দাবি জানিয়েছে সরকারের কাছে।
সিরামিক শিল্পের নেতৃবৃন্দ একটি শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ নির্মাণের গুরুত্বও তুলে ধরেন।
আশার কথা হচ্ছে বর্তমানে আমদানি করা অনেক যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রপাতি দেশেই তৈরি করা যায়। এতে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন খরচ কমবে।
সম্ভাবনাঃ
বাংলাদেশের সিরামিক শিল্প গত পাঁচ বছরে উৎপাদনে ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রিয়েল এস্টেট সেক্টরের শক্তিশালী উন্নয়ন এবং দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির কারণে এই বৃদ্ধির গতি একটি উল্লেখযোগ্য সময়ের জন্য টিকে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। শিল্পটি তার উচ্চ-মানের পণ্য, কম শ্রম খরচ এবং সৃজনশীল উদ্যোক্তাদের সাথে বিশ্ব বাজারে দ্রুত প্রসারিত হওয়ার জন্য অবস্থান করছে।
ইতালি এবং স্পেনের মতো সিরামিকের ঐতিহ্যবাহী নির্মাতারা ক্রমবর্ধমান শ্রম ব্যয় এবং চলমান বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের কারণে প্রতিযোগিতামূলক থাকতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের মতো কম দামের দেশে বেশি অর্ডার দেওয়া হচ্ছে। মানের দিক থেকে বাংলাদেশী সিরামিক সহজেই তার ঘনিষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও ভারতের পণ্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। এখন, যদি শিল্পটি সরকারের কাছ থেকে যথাযথ প্রণোদনা এবং সহায়তা পায়, তাহলে বিশ্বের শীর্ষ সিরামিক-রপ্তানিকারক দেশগুলির মধ্যে একটি হওয়ার সমস্ত সম্ভাবনা রয়েছে। অনেকটা গার্মেন্টস শিল্পের মতোই এটি হবে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি উৎপাদন সাফল্য।
লেখক: মোঃ আরিফ হোসাইন
বিজনেস ডেভলপমেন্ট ম্যানেজার