‘গৃহত্যাগ’
জেসমিন আরা বেগম :
মফস্বল শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে শিপলু। সে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়াছে। অদ্য পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হইবে। স্কুলের শিক্ষক মহোদয় হাসিতে হাসিতে বলিয়াছেন, 'সবাই ফল নেওয়ার জন্য ঝুড়ি লইয়া আসিস'। শিপলু কয়েকবার ভাবিয়াছিল আম্মাকে বলিয়া একটা ঝুড়ি চাহিয়া লইবে। কিন্তু পরীক্ষায় পাশ হইবে কি না তাহা লইয়াই যথেষ্ট সন্দেহ রহিয়াছে, এবং পাশ না করিলে কী আর ঝুড়ি ভর্তি ফল দেওয়া হইবে?
ফল প্রকাশের দিন শিপলু স্কুলে গিয়া দেখিল অন্য কোন বালকের হস্তেই ঝুড়ি নাই, ও এইবার বুঝিল শিক্ষক মহোদয় রসিকতা করিয়াছেন। শিপলু মাত্র তিন বিষয়ে ফেল করিয়া সপ্তম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হইতে পারিল না। সে অত্যন্ত ভয় পাইয়া গেলো। পিতাজি এই ফলাফল কিছুতেই মানিয়া লইবেন না। মনে আছে পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি না পাওয়ার দরুন পিতাজি পৃষ্ঠদেশে গুটিকয়েক বেত্র ভাঙ্গিয়াছিলেন। সেই বেত্রাঘাতের ব্যথা আজি এতোকাল পরেও পৃষ্ঠদেশে অনুভূত হয়। স্কুল ছুটির পরে সে বেশ কিছুক্ষণ এদিকে ওদিকে ঘুরিয়া ফিরিয়া কাটাইলো। কিছুতেই বাড়ি যাইতে মন সায় দিতেছে না, এদিকে পেটে খিদার উদ্রেক হইয়াছে। পিতার নিষ্ঠুর মারের কথা মনে হইলে অন্তরাত্মা শুকাইয়া যায়। কি করিবে কিছুই বুঝিতে পারিতেছে না। হঠাৎ মনে হইলো ঢাকায় মামার বাসায় চলিয়া গেলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। শিপলু বাসায় ফিরিলে মাতা যখন জানিতে চাহিলেন পরীক্ষার ফল দিয়াছে কি না। সে তখন অম্লান বদনে মিথ্যা করিয়া কহিল যে পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় নাই। ভাত খাইয়া মাতার দিবানিদ্রার সুযোগ লইয়া সে নিজের কয়েকটি কাপড় গুছাইয়া একটি চটের ব্যাগে ভরিয়া লইয়া লঞ্চঘাটে যাইয়া ঢাকাগামী একটি লঞ্চে উঠিয়া বসিল।
শিপলু এর আগে একবার মাত্র ঢাকায় গিয়াছে বাবা মায়ের সহিত। এক্ষণে লঞ্চ ছাড়িয়া দেওয়ার পরে সে এক ধরনের মুক্তির আনন্দে শিহরিত হইলো। সে লঞ্চের রেলিং ধরিয়া দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া চারিদিকে দেখিতে লাগিল। ছোটো বড় অনেক লঞ্চ চলিয়াছে বিভিন্ন দিকে। মাঝে মাঝে ঢেউ তুলিয়া অতি দ্রুত চলিয়া যায় স্পিডবোট। স্পিডবোটগুলো চলিয়া যাইবার পরে ঢেউ আসিয়া লঞ্চটাকে দুলাইয়া দিয়া যায়। তখন শিপলুর একটু ভয় ভয় লাগে। এইভাবে ঘন্টাখানেক পরে এসে বগা নামের এক জায়গায় লঞ্চ থামিলে শিপলু অতি আগ্রহ লইয়া লোকজনের উঠানামার ব্যস্ততা অবলোকন করিল। অনেক লোক উঠিল। আর উঠিল অনেক বড় বড় বস্তা।
আবারো লঞ্চ ছাড়িয়ে দিলে ও ডেকের এক কোনায় বসিয়া পড়িল। একটু পরে ঘুমাইয়া মাকে স্বপ্ন দেখিয়া ডুকরাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। ডেকে পাশেই অন্য একটি পরিবার শাড়ি দিয়া কিছুটা জায়গা ঘিরিয়া বিছানা করিয়া বসিয়াছিল। শিপলুর কান্না শুনিয়া মহিলা ওকে ডাকিয়া নিজেদের কাছে বসাইয়া, সঙ্গে করিয়া আনা খাদ্য খাইতে দিলো। শিপলু একেলা কোথায় যাইতেছে ভদ্রমহিলা এইরূপ অনুসন্ধান করিলে শিপলু সংক্ষেপে মামার বাড়ি যাইবার কথা বলিল।
ঘুম ভাঙ্গিয়ে শিপলু দেখিল লঞ্চখানা এক জায়গায় থামিয়া আছে। সূর্য উঠি উঠি করিতেছে। ও ঢাকায় আসিয়াছে ভাবিয়া উঠিতে গেলে, পাশের ভদ্র মহিলা বলিয়ে উঠিলেন, 'ও মনু যাও কোম্মে। মোরা কইলো এহনো ঢাকা আই নাই। এ জাগার নাম চানপুর'। শিপলু আবার জায়গায় বসিয়া পড়িল। ফেরিওয়ালারা কত রকমের যে খাবার বিক্রয় করিতেছে!
- এই চিড়া ভাজা লাগবে, চিড়া ভাজা!
হাঁক শুনিয়া শিপলু তাকাইয়া দেখিল তাহার মতই একটা বালক চিড়া ভাজা বিক্রয় করিতেছে। ও সঙ্গে থাকা টাকা দিয়া কতকটা চিড়া ভাজা ক্রয় করিয়া লইল। একটা খবরের কাগজের ছেড়া টুকরার উপরে কিছু ধবধবে সাদা ভাজা চিড়া, তার উপরে আরো সাদা কিছু কোড়ানো নারিকেল, এবং সবশেষে কিছু চিনি ছড়াইয়া দেয়া। জিনিসটা খাইতে ওর খুবই ভালো লাগিল। শিপলু অবাক হইয়া ভাবে, তাহার আম্মা কেন এই মজাদার খাবারটি কখনো বানায় নাই। এইবার বাড়ি গিয়া আম্মাকে বলিবে এমন করিয়া নারিকেল আর চিনি দিয়া চিড়া ভাজা দিতে। পরক্ষনেই শিপলুর মনে হইলো যে সে গৃহত্যাগ করিয়াছে আর ওই গৃহে ফিরিয়া যাইবে না।
ঢাকার কাছাকছি আসিয়া শিপলু আবার রেলিং ধরিয়া দাঁড়াইয়া চারিদিক দেখিতে লাগিল। কত কত জলযান ভর্তি কতশত লোক কে যে কোথায় চলিয়াছে! নদীর দুই পাড়ে কত উঁচু উঁচু দালান, এর কোনটাতে যে মামারা থাকে! সদরঘাটে লঞ্চ ভিড়িবার আগেই নৌকায় করিয়া আসিয়া কিছু লোক লাফ দিয়া লঞ্চে উঠিয়া পড়িল। শিপলু ভয় পাইয়া গেলো, ইহারা ডাকাত নাকি! কিন্তু দিনে ডাকাতি হয় বলিয়া তো সে শোনে নাই। লোকগুলো লঞ্চে উঠিয়া বলিতে লাগিল, 'কুলি লাগবে, এই কুলি'।
সদরঘাটে নামিয়া এতো লোক আর এতো ঘরবাড়ি দেখিয়া শিপলুর দিশাহারা অবস্থা হইলো।
এইদিকে সন্ধ্যা হইয়া গেলেও শিপলু বাড়ি ফিরিয়া আসিল না দেখিয়া উহার মাতা চিন্তিত হইয়া পড়িল। পাশের বাসার পল্টুর নিকট হইতে জানিল যে পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হইয়াছে এবং শিপলু অকৃতকার্য হইয়াছে। মাতাজির মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। শিপলুর পিতাজি বাড়ি ফিরিলে মাতাজি ভয়ে ভয়ে পুত্রের ফেল ও অন্তর্ধানের কথা জানাইল। অতঃপর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশী সর্বত্র খবর নেওয়া হইলো এবং কোথাও তাহার সন্ধান পাওয়া গেলো না। দুই দিন পরে শিপলুর আম্মার কান্নাকাটি সহ্য করিতে না পারিয়া ওর আব্বা নিজের কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে পুত্রের খোঁজ করিতে ঢাকা পাঠাইল।
শিপলুর চাচা ঢাকায় নামিয়া অত্যন্ত ক্ষুধার্ত বোধ করিল। সে সদরঘাটের একটা সস্তা হোটেলে নাস্তা খাইতে বসিল। চাচা বসিয়া বসিয়া উদাস হইয়া ভাবিতেছিল এতো বড় ঢাকা শহরে কোথায় ভ্রাতুষ্পুত্রকে খুঁজিয়া পাইবে।
হঠাৎ টং করিয়া স্টিলের গ্লাস টেবিলে রাখিবার শব্দে চাচা চমকিয়া তাকাইয়া চট করিয়া ছোট্ট একখানা হাত শক্ত করিয়া চাপিয়া ধরিল।
হাত ধরামাত্র শিপলু তাকাইয়া দেখে তাহার-ই চাচার শক্ত হাতের মুঠির মধ্যে তাহার ছোট্ট হাতের কব্জিখানি আটকা পড়িয়াছে, ছুটাইয়া লইবার মত শক্তি তাহার শরীরে নাই।
(ইহা একটি কাল্পনিক গল্প।
লেখক পরিচিতি :
জেসমিন আরা বেগম,
কেমিকৌশলী, ১৩ তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য এবং বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী।
প্রাক্তন উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, (বিপিএটিসি)।