বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

গোবরে কি পদ্মফুল ফোটে ?

মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ২৮, ২০২১
গোবরে কি পদ্মফুল ফোটে ?

ডা. আফতাব হোসেন :

কয়েকদিন আগে ঢাকা গিয়েছিলাম সপরিবারে একটা বিয়ে খেতে। ঢাকা যাব, আর গিন্নী শপিঙে যাবেন না, তা কি হয়? যথারীতি একদিন শপিঙে যেতে হল গিন্নীর সাথে। গিন্নীর শপিং মানে দোকানে দোকানে ঘোরা। যতটা না কেনা, তারচেয়ে অনেক বেশি দেখা। কেনাকাটার ব্যাপারে আমি তার পুরাই উলটা। কেন জানি না, বাজারে গেলেই আমার হাই ওঠে, চোখে জল আসে, পায়ের বল পড়ে যায়। না, এ জন্য নয় যে আমি কৃপণ, কেনাকাটায় ভয় পাই। বরং কিনতে আমার ভালোই লাগে। তবে এক দোকানেই ঢোকা, এক দোকানেই কেনা। অথচ গিন্নীর সব দোকান ঘুরে দেখা চাই। পাছে সবচেয়ে ভালো জিনিষটা তার দৃষ্টির অগোচরে রয়ে যায়! ঘণ্টা চারেক দোকানে দোকানে ঘুরতে ঘুরতে আমি তখন ত্যক্ত, বিরক্ত, ধৈর্যের শেষ সীমায়। ব্যথায় পা টনটন করছে। বুড়ো শরীরে এত ধকল সইবে কেন? অথচ বাজারে এলেই বুড়ি আমার যেন এক ষোলো বছরের কিশোরী হয়ে যায়। নাওয়া খাওয়া ভুলে প্রজাপতির মতো এক দোকান থেকে অন্য দোকানে উড়ে বেড়ায়। বাজারে এলে মেয়েরা এত প্রাণশক্তি কোথায় পায় কে জানে? কিন্তু উপায় নাই গোলাম হোসেন। মহারানীর পিছনে পিছনে আমাকে বশংবদ গোলামের মতো হাঁটতে হবে আর একান্ত বাধ্যগত মোসাহেবের মতো তার পছন্দের সাথে মাথা দোলাতে হবে! যথারীতি টই টোপলা নিয়ে মহারানীর পিছে পিছে হাঁটছি আর নিজের ভাগ্যের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছি। এমন সময় এক ভিখারিনী পথ আগলে দাঁড়াল। বছর পঞ্চাশেক বয়স। বেশ গাট্টা গোট্টা শরীর। গায়ের রঙ ময়লা। তার চেয়েও ময়লা পরনের কাপড়। 

এমনও দিন গেছে, যখন দরজায় কড়া নড়া বন্ধ হত না। না, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব কিংবা পাড়া প্রতিবেশীদের জন্য নয়, ভিক্ষুকদের জন্য। হ্যাঁ, আমি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের কথা বলছি। তখন বাংলাদেশে বছরে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৮৮ ডলার বা ৬৭৬ টাকা। গ্রামে ফসল নেই, শহরে চাকরি নেই, মুখে অন্ন নেই, পরনে কাপড় নেই। এক মুঠো চাল কিংবা একটু ভাতের জন্য দরজায় অবিরাম কড়া নেড়ে যেত কঙ্কালসার ভিক্ষুকের দল। মিলের গেটে, রাস্তায়, ষ্টেশনে কিংবা বাজারে, লাইন ধরে দাঁড়িয়ে হাত পেতে থাকত একটি পাঁচ পয়সা কিংবা দশ পয়সার আশায়। ছিল না তাদের একটু মাথা গোঁজার ঠাই। রাতে খোলা আকাশের নীচে মাঠে কিংবা ফুটপাতে, লঞ্চ ঘাট কিংবা রেল ষ্টেশনে, সারি সারি শুয়ে থাকত সব মানব সন্তান। লেপ কম্বল তো দূরের কথা, একটা ছেঁড়া কাঁথাও থাকত না তাদের গায়ে। শীতে গায়ে গা মিশিয়ে শুয়ে থাকত একে অন্যের শরীরের ওম নিতে। শুধু তাই নয়, জীবিতাবস্থায় যাদের আব্রু ঢাকেনি কাপড়ে, মৃত্যুর পরে সেই আব্রু ঢাকতে হত ছালার চটে কিংবা হোগলা পাতার চাটাইয়ে। আজকের প্রজন্ম কল্পনাও করতে পারবে না, যতটা কষ্ট হয়েছিল স্বাধীনতা অর্জন করতে, তার চেয়ে বহুগুণ কষ্ট সয়েছিল মানুষ সেই স্বাধীনতাকে ধরে রাখতে। 

এখন দিন অনেক বদলে গেছে। স্বাধীনতার সুফল পেতে শুরু করেছে স্বদেশ। যাদের শোষণের হাত থেকে বাঁচতে রক্তে নেয়েছিল এই দেশ, জীবন যাত্রার মানে তাদের আমরা ছাড়িয়ে গিয়েছি অনেক আগেই। এমন কী উপমহাদেশের পরাশক্তি ভারতকেও ছাড়িয়ে গিয়েছি আমরা মাথাপিছু আয়ে। বাংলাদেশের জিডিপি এখন ২২২৭ ডলার। রাজধানীর আকাশ ছুঁয়ে আছে শত সহস্র বহুতল অট্টালিকা। চোখ ধাঁধানো সব শপিং মলে ভরে গেছে শহর। যে রাজপথে একসময় মুড়ির টিন মার্কা বাস, বেবিট্যাক্সি আর রিকসা ঘুরে বেড়াত, কালে ভদ্রে দু একখানা প্রাইভেট কার দেখা যেত, সেই পথে এখন নামী দামী অভিজাত গাড়ির ভিড়ে তিল ধারণের ঠাই নেই। এখন আর এক মুঠো চাল কিংবা ভাতের জন্য দরজায় কড়া নাড়ে না কেউ। বাংলাদেশের মাঠে ঘাটে না খেয়ে মরে পড়ে থাকে না আর কোনো আদম সন্তান।

তাই বলে কি বাংলাদেশ থেকে ভিক্ষাবৃত্তি পুরাপুরি উঠে গেছে ? না, উঠে যায়নি। বরং বলা যায় ভিক্ষুকরাও এখন অভিজাত হয়েছে। বদলেছে ভিক্ষার ধরণ। এখন আর তারা অন্নের জন্য ভিক্ষা করে না। ভিক্ষা করে অভিনব কারণে। কেউ চিকিৎসার কথা বলে, কেউ মেয়ে বিয়ে দেয়ার কথা বলে, কেউ স্বামী হারিয়েছে, কেউ বা সন্তান। এরা কেউ আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা করার কষ্ট করে না। বরং কোনো এক নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে পথচারী কিংবা গাড়ির জানালায় টোকা দিয়ে আরোহীদের কাছে টাকা চায়। শুনেছি, ঢাকায় ভিক্ষুকদেরও সিন্ডিকেট আছে। কোনো কোনো ভিক্ষুকের আয় নাকি মাসে লাখ টাকার উপরে। তাদের পোশাকে কৃত্রিম দৈন্যতার ছাপ থাকলেও শরীরে অভাব কিংবা অনাহারের ছাপ খুঁজে পাওয়া যায় না। সামনে দাঁড়ানো ভিখিরিনীকে আমার তাদেরই একজন বলে মনে হল। ভিক্ষাবৃত্তিকে আমি ঘৃণা করি। বিশেষ করে যখন ভিক্ষাবৃত্তিকে একটা লাভজনক পেশা হিসেবে বেছে নেয়। তাদেরকে আমি কখনই ভিক্ষা দেই না। এমনিতেই মেজাজটা খিঁচরে ছিল। এবার আরও বিগড়ে গেল। একটা কড়া ধমক দিতে যাব, এমন সময় ধক করে উঠল বুকের ভেতর।

মেঘের আড়াল থেকে যেমন উঁকি দেয় পূর্ণিমার চাঁদ, অমনি ঝলমল করে ওঠে রাতের আকাশ, এক নৈসর্গিক আলোয় ভরে যায় পৃথিবী, তেমনই মহিলার ময়লা শাড়ির আঁচলের ফাঁক গলে উঁকি দিল চাঁদের মতো এক অনিন্দ্য সুন্দর মুখ! ছয় সাত বছর বয়স। পরনে সবুজ রঙের এক ফ্রক। তাতে হলুদ ফুল। মহিলার কাপড়ের মতই ময়লা। তবে সে ময়লা এতটুকু স্পর্শ করতে পারেনি মেয়েটির মুখ। সোনার মতো রঙ। পাতলা গোলাপি ঠোঁট। টিকালো নাক। টলটলে দুই চোখ। ধমকটা গলার কাছেই আটকে রইল। কিছুক্ষণ অনিমেষ তাকিয়ে রইলাম মেয়েটির দিকে।

- ছার, একটু সাহায্য করেন।

মহিলার কথায় ধ্যান ভাঙ্গল আমার। তখনও হাত বাড়িয়ে আছে ভিখিরিনী। সে হাতের মুঠোয় বেশ কিছু দশ টাকার নোট। ইদানীং আবার দশ টাকার কম ভিক্ষা দিলে ভিখিরিদের মন ভরে না আর দাতাদেরও ইজ্জত থাকে না। জানতে চাইলাম,

- মেয়েটি কে?

- আমার নাতনী।

- ছেলের ঘরের না মেয়ের ঘরের?

- ছেলের।

- ছেলে কই?

- মইরা গ্যাছে।

- ছেলের বউ?

- ভাইগা গ্যাছে।

আসলেও কি গোবরে পদ্মফুল ফোটে? আমি জানি না। তবে এমন গোবরে মুখো দাদির যে এমন চাঁদ মুখো নাতনী হতে পারে, আমার বিশ্বাস হল না। নিশ্চয়ই বানিয়ে বলছে। শুনেছি কেউ কেউ নাকি বাচ্চা ভাড়া করে এনে মা সেজে ভিক্ষা করে। বয়সের কারণে এ হয়ত দাদী সেজে ভিক্ষা করছে। মানুষের সহানুভূতি আদায় করতে বাচ্চাদের ব্যবহার করে। আহারে ! না জানি কোন মায়ের সন্তান। সামান্য কটা টাকার বিনিময়ে ভাড়া দিয়েছে ভিক্ষা করতে। ওর তো এখন পুতুল নিয়ে খেলার কথা কিংবা বই নিয়ে পড়তে বসার কথা। সম বয়সীদের সাথে বুড়ি ছি খেলার কথা। তা না করে এই বুড়ি ধারীর সাথে ভিক্ষা করছে! ভিক্ষা করতে করতে বড় হবে। ওর শিশু শরীর বালিকা থেকে কিশোরী হবে। ফুলে ফলে সুশোভিত হবে। একদিন হয়ত বস্তির কোনো লম্পট কুকুর কিংবা বয়স্ক শকুন সেই ফল ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে। ঐ নির্মল মুখে লেপটে যাবে কলঙ্কের কালিমা। ভাবতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম,

- কী নাম তোমার?

- জরীনা।

আমার হঠাৎ হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের দুই মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল। হুমায়ুন আহমেদ নিশ্চয়ই এমনই একটা নিষ্পাপ কোমল মুখ কল্পনা করে নাম রেখেছিলেন জরী আর পরী। এই মেয়ের নামও জরী কিংবা পরী হওয়া উচিৎ ছিল। আহা, আমার যদি এমন একটা মেয়ে থাকত! নাম রাখতাম, পরী। জানতে চাইলাম,

- স্কুলে যাও?

এদিক ওদিক মাথা নাড়ল মেয়েটি। বুকটা কেমন করে উঠল! বললাম,

- আমার সাথে যাবি? তোকে ভালো কাপড় দেবো। ভালো খেতে দেবো। বই কিনে দেব। স্কুলে ভর্তি করে দেবো। 
শুনে মেয়েটি ভয়ে দাদীর নোংরা আঁচলে মুখ লুকালো। হয়ত আমাকে কোনো মেয়েধরা ভেবেছে। হেসে বললাম,

- ভয় নেই। তোর দাদীকেও সঙ্গে নেব। তাকেও খেতে দেব, পরতে দেব। আর ভিক্ষা করতে হবে না, আর কোনো কষ্ট থাকবে না।  

দেখি, মেয়েটি এবার শক্ত করে তার তথাকথিত দাদির শাড়ি খামচে ধরল। আর তখনই মহিলা ঝামটা মেরে উঠল,

- অত কথার কাম কী? ভিক্ষা দিলে দ্যান, নাইলে যাই।

বুঝলাম, ভিক্ষুকের কাছেও টাইম ইজ মানি। একজনের জন্য বরাদ্দ সময় শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। আজাইরা প্যাঁচাল পাইরা আর লোকসান গুনতে চায়না পেশাদার ভিখারিনী। পকেট থেকে বিশ টাকার একটা নোট বের করে মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে বললাম,

- নাও।

মেয়েটি হাত বাড়াবার আগেই মহিলা ছো মেরে টাকাটা নিয়ে ওর হাত ধরে টানতে টানতে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। যেতে যেতে মেয়েটি একবার পিছন ফিরে চাইল। ওর কাজল কালো টলটলে দুই চোখ কি একটু ছলছল করে উঠল? সেখানে কি ফুটে উঠল কোনো আকুতি? ও কি বলতে চাইল, কেন তুমি আমার বাবা হলে না? তাহলে তো আজ আমাকে এমন করে ভাড়ায় ভিক্ষা করতে হত না!

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললাম, মারে, পরের জন্মে আমার ঘরে মেয়ে হয়ে জন্মাস তুই। কথা দিলাম, এক জীবনের সকল সুখ এনে ঢেলে দেব তোর পায়। আমার চোখও কি ভিজে উঠল এক না পাওয়ার বেদনায়? ভাগ্যিস, কেনাকাটায় ব্যস্ত বউ তা দেখতে পেল না!


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল