একজনই
প্রচন্ড ঝোড়ো হাওয়া যখন,
কুণ্ডলীকৃত মেঘেদের টেনে নিয়ে আসে
আমার ঘরের পেছনের নারকেল গাছটার ওপর,
বিদ্যুৎ চমকের ঝলসানিতে ঝলসে দিয়ে যায়,
মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ গাছটির মাথা,
টিনের চালের ওপর আছড়ে পড়ে
কচি ডাব, পাতা আর ছিন্ন ভিন্ন কিছু কান্ড।
তার সাথে পড়তে থাকে
লিচুর আঁটির মতো গোটা গোটা শিলা,
ধারালো সুঁইয়ের মতো অজস্র বৃষ্টির ঝাঁক।
সে এক আসুরিক বৃষ্টির রাত।
গোয়ালে বাঁধা গরুটার গোঙানি শুনে,
যদি ঘর থেকে বের হই,
যদি তক্ষুনি পা হড়কে ধপাস করে পড়ি,
পিছলে মাটির পরে
আর মড়াৎ করে দুই টুকরো হয়ে যায় হাঁটুর হাড়খানা।
নিদারুণ যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠতে থাকে,
কাউকে ডাকতে থাকে মন।
কোনো নালিশ বা অনুযোগ নয়
বরং সন্ত্রস্ত হয়ে অবচেতন মন
কারও নাম মনে মনে জপতে থাকে।
কারও যেন অনুরাগ খুঁজতে থাকে।
ওগো বিদুৎ ঝলসানো রাত,
ওগো প্রচন্ড ঝোড়ো হাওয়া,
তোমরা সাক্ষী থেকো আমার সে প্রিয়জন একজনই।
অনেক নামের ভীড়ে, অনেক জনের ভীড়ে,
আরও বেশি বিহ্বল হবার শক্তি আমার নেই।
একটা উত্তাল সমুদ্রের মাঝে সাইক্লোন হানা দেয় যদি,
জাহাজটা থরথর কাঁপছে,
পাল ছিঁড়ে, হাল ভেঙে ভজঘট দশা,
হুট করে ইঞ্জিনও বিকল হলো।
আমি এক গোবেচারা নিরীহ যাত্রী,
একমাত্র শিশুকন্যাকে বুকে নিয়ে
জাহাজের ডেকে বসে টালমাটাল,
তখন আমার আর কিচ্ছু করার নেই,
কিচ্ছু ভাবার নেই অনিঃশেষ সাহসের আশ্রয় ছাড়া।
নিমেষে চুপসে যায় রঙিন জীবনখানা
চুপসানো বেলুনের মতো।
ধড়ফড় কলিজাটা আনচান করে ওঠে,
একটামাত্র নামই ডেকে যেতে পারে।
ওগো ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মরণ সাগর,
ওগো পাল ছেঁড়া, হাল ভাঙা ঠুনকো জাহাজ,
তোমরা সাক্ষী থেকো আমার সে আশ্রয় একজনই।
পিতা, পুত্র কি'বা প্রতিপালকের মাঝে,
খুঁজে, পেতে বেছে নেবার সাহস আমার নেই।
দিনটা হয়তো খুব আলোকোজ্জ্বল আর আনন্দিত,
আত্মীয়-পরিজনে পরিবেষ্টিত।
আচমকা যদি শুনি খুব প্রিয়জন কেউ মুমূর্ষু প্রায়।
ধড়াস বুকের মাঝে ছটফট করে ওঠে হৃৎপিণ্ডটা,
নিমেষে আলোর দিন, আনন্দ সীমাহীন পলাতক হাওয়া।
একটা কাউকে খুব আঁকড়ে ধরতে মন বিচলিত হয়,
ওগো আনন্দ মুছে দেওয়া হঠাৎ বিপদ,
ওগো প্রিয়জন হারানোর বেপরোয়া ভয়,
তোমরা সাক্ষী থেকো আমার প্রতিপালক একজনই।
তেত্রিশ কোটির মাঝে,
একখানা খুঁজে নেবার সাধ্য আমার নেই।
আমি যে ভীষণ সোজা, চিরকাল একমত, একপথে চলি।
শেখ ফাহমিদা নাজনীন
২৩ ডিসেম্বর ২০২১।