দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায়
নদীর ভয়াল গ্রাসে যথাসর্বস্ব বিলীন করে,
সর্বস্বান্ত হয়ে, যে দুর্ভাগা জনতার সমুদ্রে এসে দাঁড়ায়,
তার সর্বাঙ্গে একখানা ভেজা তহবন্দ লেপ্টে থাকে,
ঝাকড়া চুলের গোছা থেকে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে,
যেমন করে সূর্যের তাপে নদীর উত্তাল বুকে ফাটল ধরে,
তেমন করেই সূর্য তাকে শুকিয়ে দেয়।
সে হয়তো কাপড়ের মিলের পাশে দাঁড়িয়ে,
তবু গা মোছার একটা মাত্র গামছাও বানের স্রোতে ফেলে এসেছে।
তাই সূর্যের প্রখর রোদকে সম্বল করে সে দাঁড়িয়ে থাকে,
এতো বড়ো পৃথিবীর এককোণে,
একটা বিন্দুর চেয়েও ছোট সে,
কেউ তাকে গ্রাহ্যই করেনা।
তবু সে আপন অস্তিত্বে বিরাজমান।
তার চোখে তুমি ভয় দেখতে পাবে না কখনো,
সে দরিয়ার ভয়াল গ্রাসে ডুবে যেতে দেখেছে,
মা-বাবা আর একটা মাত্র ছোট বোনকে।
যার সর্বস্ব ডুবে যায়, তার আর হারাবার ভয় কিসে?
যুদ্ধবন্দী যে ফিলিস্তিনি যুবকটিকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে ক্ষুদ্র সেলের ভেতর,
সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলে মাথা আটকে যায়
ছাদের শক্ত পলেস্তারায়,
পায়ের নীচে কংক্রিটের রুক্ষ মেঝে,
হাত-পায়ের বাঁধন যেন দাঁত বসিয়ে দিচ্ছে চামড়ার ওপর,
অজস্র নির্যাতনের চিহ্ন বহন করে চলেছে তার সমস্ত শরীর।
তুমি যদি তাকে দেখো,
আর নীল ঝকঝকে চোখদুটো দেখে নিও।
কি প্রগাঢ় নির্ভয়! সেখানে বাসা বেঁধেছে।
যে স্বাধীনতার জন্য প্রিয়জনের প্রিয় সম্মোধন অগ্রাহ্য করতে পারে,
তার আর হারাবার ভয় কিসে?
যে রক্তাক্ত, ক্ষুধার্ত উইঘুর মেয়েটিকে কিছুক্ষণের বিরতিতে
ফেলে রাখা হয়েছে রুক্ষ কার্পেটের ওপর।
তখন যদি খানিকটা মদ আর শুকরের মাংস দিয়ে তাকে বলা হয়,
এটা খাও আর বাঁচো।
তুমি দেখবে কি তীব্র ঘৃণায় সে চেয়ে আছে সেই অখাদ্যগুলোর দিকে!
হয়তোবা টানা তিনদিন এক ফোঁটা পানিও জোটেনি তার।
তবু তার কালো জ্বলজ্বলে চোখদুটি যদি তুমি দেখো,
দেখবে কি অতুগ্র বিবমিষা উথলে উঠছে তার কালো চোখে!
ঐ সুখাদ্যগুলি! গলধকরণ করার চেয়ে মৃত্যুই তার কাছে উপাদেয়।
সে তার জ্বলজ্বলে কালো চোখে আপন বাস্তুভিটা পুড়ে যেতে দেখেছে,
তার সাথে ঝলসে গেছে মা-বাবা আর অন্ধ দাদির দেহ,
ছোট্ট ভাইটি ছিলো সবচেয়ে ছটফটে, সবচেয়ে নিজস্ব,
তার ছোট্ট মিষ্টি মাথাখানা ছিঁড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিতে দেখেছে ঐ আগুনের মাঝে।
সর্বস্ব ঝলসে গিয়ে নিজেকে সর্বহারা হতে দেখেছে সে জ্বলজ্বলে কালো চোখ।
কেমন করে ও চোখে অশ্রু দেখবে বলো?
যার সকল অশ্রুধারা দাউদাউ আগুনে ঝলসে গেছে,
তার আবার হারাবার ভয় কিসে?
পৃথিবীর জনপদে, বন্দরে, অন্দরে, তামাম জায়গা জুড়ে,
যখনই যে জাতি হয় সর্বহারা,
দেয়ালে যখনই কারো পিঠখানা ঠেকে যায়,
ঘুরে ঠিক দাঁড়াবেই।
সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে আজ তুমি যে জাতিকে পথে এনে দিলে,
তাদের আর হারাবার ভয় কিসে?
মৃত্যুকে নিয়ে তারা মৃত্যুঞ্জয়ী খেলা খেলবেই।
শেখ ফাহমিদা নাজনীন
৩১ ডিসেম্বর ২০২১।