তাবিজ
- শেখ ফাহমিদা নাজনীন
তোমরা কে গো পরম হিতৈষী, আপনার জন, তন্ত্র মন্ত্রের একগাদা তাবিজ নিয়ে এসেছো?
ভূপৃষ্ঠ স্পর্শ করতেই আমার সর্বাঙ্গে বেঁধে দিলে তাবিজের স্তুপ।
আমার ওজন ছিলো বড়জোর তিন কেজি,
তোমাদের তাবিজগুচ্ছ দিয়ে তা বোধকরি সোয়া তিন কেজিতে গিয়ে দাঁড়ালো।
আমার সুস্থ সবল দেহ তোমাদের মন ভোলাতে পারেনি,
তোমরা আরও কিছু চেয়েছিলে।
মন্ত্রের বাঁধনে বেঁধে দিলে আমার আপাদমস্তক,
তোমাদের কতো রকম তুকতাক আর বশীকরণের ফাঁদে পড়ে
মানবাত্মার তখন ত্রাহি ত্রাহি দশা।
যখন আমি মাতৃগর্ভে নিশ্চিন্তে একটু ঘুমাতে চেয়েছি,
তখনও তোমরা ছাড়োনি।
আমাকে হাতের নাগালে না পেয়ে,
মায়ের ওপর চাপিয়েছো বশীকরণের হাজারটা ছলাকলা।
অথচ আমায় যিনি পাঠিয়েছেন,
একটি জ্ঞানগর্ভ পুস্তকে সমস্ত নির্দেশ উল্লেখ করেছেন আমার জন্য,
আমি আসবো বলে,
থরে থরে সাজিয়ে রেখেছেন মানুষ হবার সমস্ত কলাকৌশল।
তার যে কোনো কৌশলেই ফুঁৎকার উড়িয়ে দিতে পারি
ডাইনী- কুহকিনীদের পাতা ফাঁদগুলো,
পুস্তকের পাতায় পাতায় উচ্চকিত দৈব বাণী,
নিমেষে ঝলসে দিতে পারে অজস্র যাদুকরীর কুটিল যজ্ঞ।
শুধু তোমরা তা বোঝোনি,
তোমরা ঐ মনুষ্যবিধ্বংসী যজ্ঞে আত্মাহুতি দেবার জন্য তৈরি হয়েই ছিলে,
তাই খুব সহজেই ধরা পড়ে গেছো তাদের পাতা মরণ ফাঁদে।
তারা উচ্ছিষ্টের মতো তোমাদের হাতে ধরিয়ে দিলো,
একগাদা শেকড়বাকড়, জড়িবুটি।
তোমরা সামান্য ব্যাথাউপশমকারী এসকল জড়িবুটিকে
মহার্ঘ্য ভেবে মাথায় তুলে নিয়েছো।
যারা শেকড়ের শক্ত তোমাদের বেঁধে ফেলেছে,
তাদের রক্ষাকর্তা ভেবে প্রভুত্বের আসনে বসিয়ে দিয়েছো।
অথচ এসকল শেকড়বাকড় যে সব গাছ থেকে এসেছে,
এসকল জড়িবুটি যে সব পাতার নির্যাস,
তারা সদলবলে কেবল তোমাদের অধিনস্ত ছিলো।
একটা মস্ত বড়ো ধাতব মাদুলি ঝুলিয়ে দিয়েছো আমার গলায়,
তার পরতে পরতে মিশিয়ে দিয়েছো তেত্রিশ কোটি দেবতার নামাঙ্কিত বশীকরণ ফুঁৎকার!
সেই সব উৎকৃষ্ট নিঃশ্বাসে আমাকে তোমরা বিপদমুক্ত রাখতে চেয়েছো।
অথচ –
আমি কখনো গোল্লায় যেতে থাকি অসৎ পাল্লায় পড়ে,
কখনো অন্যের সম্পদ দখল করি নির্দিধায়।
আমি এতটাই উৎকৃষ্ট হয়ে উঠি যে,
অন্যের স্বপ্নেও হানা দিয়ে বসি দুঃস্বপ্নের মতো।
এগুলো কি মস্ত বড়ো বিপদ নয়?
তাই তোমাদের মঙ্গল কামনায়
তেত্রিশ কোটির দোহাই দেয়া তুকতাকের ওপর আমি আস্থা হারিয়ে ফেলি।
ধ্বংসের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে শুধু সেই তাবিজখানাই পেতে চাই,
যার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে,
মানবাত্মার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষার অমিয় বানী,
যা শুধুমাত্র তাঁর কাছ থেকেই এসেছে,
যিনি আমাকে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন।
শেখ ফাহমিদা নাজনীন
২ জানুয়ারি ২০২২