সময় জার্নাল প্রতিবেদক : কেউ নিখোঁজ হয়েছেন সাত বছর আগে, কেউ তারও আগে। তাদের স্বজনরা এখনও জানেন না রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে যাওয়া ওই প্রিয়জন বেঁচে আছেন কিনা, কখনও ফিরে আসবেন কিনা। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নতুন করে তাদেরকে হয়রানি করছে বলে অভিযোগ তোলেন গুমের শিকার পরিবারের সদস্যরা। তারা বলেন, আমরা প্রতিমুহূর্তে মরে যাচ্ছি। আমরা জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি। আমাদের মুখে কখনও হাসি আসে না। আমাদেরকে আর মানসিক নির্যাতন করবেন না।
শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সংগঠন 'মায়ের ডাক' আয়োজিত এক সভায় গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা এসব কথা বলেন। তাদের বক্তব্যে আর চোখের পানিতে পুরো সেমিনার ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। অনেককেই এসময়ে চোখ মুছতে দেখা যায়। গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবারগুলোর প্রতি শুরু হওয়া হয়রানির প্রতিবাদে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্ত্রীরা বলেন, ‘আমাদের ঘরে কোনো অনুষ্ঠান হয় না। আমার বাচ্চারা জিজ্ঞেস করে, সবার তো বাবা আছে, আমাদের বাবা নেই কেন। আমি উত্তর দিতে পারি না। আমার স্বামীকে মেরে ফেললে তার মরদেহটা দেন, আমরা মাটি দেব। আমরা একটু মিলাদ পড়াতে চাই। আর বেঁচে থাকলে সেই তথ্যটা আমাদের দেন, তিনি কোথায় আছেন। আমাদের চোখের পানি নিয়ে এমপি-মন্ত্রীরা উপহাস করেন, হাসে। তারা বলেন, আমাদের স্বামীরা বিয়ে করে অন্য কোথাও চলে গেছেন। দেশে নাকি গুম নেই।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আর জাতিসংঘের চিঠিতে সরকার ও পুলিশ ভয় পেয়েছে। এজন্য নতুন করে গুম ব্যক্তির পরিবারকে হয়রানি করছে। এর মাধ্যমে তারা বাঁচতে চাইছে। কিন্তু পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এটা করে তাদের আরো অপরাধের মাত্রা বাড়ছে। একদিন এসব গুমের, এসব হয়রানির বিচার হবেই। কেউ রেহাই পাবে না।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশকে এই সরকার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। এজন্য সরকার ও পুলিশ একসঙ্গে ধরা খেয়েছে। সরকারের পতনের ঘটনা বেজে গেছে। আগামী নির্বাচনে তারা ভোট ডাকাতির স্বপ্ন দেখতে পারে, কিন্তু সে আসায় গুড়ে বালি। পুলিশ তাদের রক্ষা করতে পারবে না।’
গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘সরকারের এখন মাথা খারাপ। আন্তর্জাতিক চাপ সৃস্টি হওয়ায় তারা গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারে ভয়ভীতি সৃষ্টি করছে। কিন্তু গুম হওয়া ব্যক্তির খোঁজ দিতে না পারলে তাদেরকে (সরকার) ক্ষমতা থেকে নামিয়ে জনগণ বিচার করবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘একটি দেশের সরকার কতটা বর্বর হলে এ ধরনের গুম সংস্কৃতি চালু করতে পারে। এখন বর্বরতার নতুন মাত্রায় সাজানো জবানবন্দিতে স্বাক্ষর নেওয়া হচ্ছে। তাদের এ কাজকে ধিক্কার জানাই। একদিন এসব মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হবে।’ গুমের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে গুম পরিবারকে তথ্য ভাণ্ডার খোলার আহ্বান জানান তিনি।
গুম হওয়া পারভেজের স্ত্রী ফারজানা বলেন, ‘আমার স্বামীকে গুম করার পর এখন আমাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। নিয়মিত আমাদের বাসায় পুলিশ আসে। কিছুদিন আগে এক আওয়ামী লীগের নেতাসহ পোশাক পরিহিত একজন এবং পোশাক ছাড়া বেশ কয়েকজন পুলিশ রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমাদের বাসায় আসেন। আমি বাসায় ছিলাম না। পুলিশ আমার শাশুড়িকে বলেন যে, আপনার ছেলের বউ আপনার কাছ থেকে ছেলেকে আলাদা করে রেখেছে। সে জানে আপনার ছেলে কোথায় আছে। এভাবে আমাদের মানসিক নির্যাতন করছে পুলিশ।’
মায়ের ডাকের সংগঠক আফরোজা ইসলাম আঁখির সভাপতিত্বে ও বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতির চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান প্রমুখ।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষে বক্তব্য রাখেন লক্ষ্মীপুরে গুম হওয়া আলমগীর মোল্লার বাবা মো. শাহজাহান মোল্লা, ফরিদ আহমেদ রাজুর বোন শিল্পী আক্তার, মীরপুরের গুম হওয়া ইসমাইল হোসেন বাতেনের স্ত্রী নাসরিন আক্তার স্মৃতি, আব্দুল কাদের মাসুম ভূইয়ার মা আয়শা আলী, সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের মাহাবুব সুজনের ভাই জাহিদ খান সাকিলসহ প্রমুখ।
সময় জার্নাল/এসএ