বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

বাঁশের সাঁকো

মঙ্গলবার, জানুয়ারী ২৫, ২০২২
বাঁশের সাঁকো

আনোয়ারুল কাইয়ূম কাজল  :

বাঁশের সাঁকো গ্রামীণ জনপদের  অনন্য ঐতিহ্যির নির্দশন। যা ছিল চিরায়ত আবহমান বাংলার চিরচেনা দৃশ্য ।  নদ-নদী,খাল,বিল পারাপারের সহজ মাধ্যম হিসেবে ব্যাবহৃত হতো এটি। পল্লী গ্রামে বর্ষার মৌসুমে  নদ-নদী,খাল,বিল পানিতে কিংবা কাঁদায় পরিপূর্ণ থাকতো তখন সেসব জায়গা দিয়ে সহজে যাতায়াত ও পারাপার হওয়ার জন্য সাঁকো ব্যাবহার হতো। নদী, খাল বা যেকোনো জলাশয়ের ওপর দিয়ে পারাপারের জন্য সবচেয়ে সহজ পন্থা হচ্ছে সাঁকো। 

অনেক আগে থেকেই এই ভূখণ্ডে সাঁকোর প্রচলন ছিল। সভ্যতার বিকাশে ইট পাথরের ব্যাবহারের ফলে সাঁকো দেখতে পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। দিনে দিনে এটি পল্লীবাংলা থেকে বিলুপ্ত হয়েছে যাচ্ছে । তবে গ্রাম-গঞ্জে এখনো কোথাও কোথাও  খুব কম সংখ্যক ঐতিহ্যের স্মারক সাঁকোর দেখা মেলে। 

সাঁকোর রূপক অর্থ ও বাংলা সাহিত্যে পরিব্যাপ্তি
********************************
সাঁকো শব্দর অর্থ হলো পোল বা সেতু। 

বাঁশ বা গাছের গুড়ি বা কাঠ দিয়ে তৈরি হলেও এটি বাঁশের সাঁকো নামেই পরিচিত।  প্রতীকি বা  রূপক অর্থে  সেতুবন্ধন, মেলবন্ধন, ঐক্যমত্য  প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়। পাড়া মহল্লা গ্রাম গঞ্জে পারিবারিক সামাজিক ধর্মীয় সম্পর্ক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ভালোবাসা সহমর্মিতা তৈরিতে সাঁকো 
গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা রাখে।

শব্দটি ইতিহাস ঐতিহ্য ও বিভিন্ন বিখ্যাত স্থান,ব্যক্তি ও কিংবদন্তি নামের সাথেও জরিয়ে আছে নানাভাবে।

সাঁকো থেকে যশোর নামেরও উৎপত্তি বলেও প্রচলিত মত আছে। ফরাসি শব্দ ‘জসর’ থেকে যশোর শব্দটি এসেছে। ‘জসর’ অর্থ সাঁকো। এককালে যশোরের সর্বত্র নদীনালায় পরিপূর্ণ ছিল। নদী বা খালের ওপর সাঁকো বানানো হতো। পীর খানজাহান আলী বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করে ভৈরব নদ পেরিয়ে মুড়লীতে আসেন বলে জানা যায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থান জোড়াসাঁকোর নামের সঙ্গে সাঁকো শব্দটি জড়িত।

সাঁকোর পরিব্যপ্তি ও সার্বজনীনতা নিয়ে  বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে নানারকম গল্প,উপন্যাস,ছড়া,কবিতা,গান,নাটক,তথ্যচিত্র, ও সিনেমা ইত্যাদি। 

বিলুপ্ত সাঁকোর কবি- মোহাম্মদ  শোয়াইবুল ইসলাম বিলুপ্ত সাঁকো কবিতায় বলেন-

পথে দাঁড়িয়ে থাকো,ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকো,
আমি নক্ষত্র হাতে নিয়ে,জোছনা মেখে---
বিলুপ্ত সবুজ মাঠে এঁটে দেব
আমার মুঠো ভরা ঋণের বিশ্বস্ত হাত;
তোমার স্বাপ্নিক শহরের ছোট্র জানলা-
আর দরজা খুলা রেখো,
আমি ভোরের নৈসর্গিক বাতাস হয়ে-
সকাল বেলার মধুর সুরের পাখি হয়ে-
প্রতীক্ষায় বিমর্ষ সাঁকো বেয়ে,
ঢুকে পড়বো তোমার শহরে;
একান্ত তোমার শরীরে।

মানিকনগর কবিতায় কবি তাইবুল ইসলাম ইসলাম লিখেছেন -

এই ভাঙা সব ফাঁটল ধরা রাস্তায় –
আমি খুঁজে বেড়াই…….
খুঁজে বেড়াই আমারই বড় হওয়ার মানে ।

এই রাস্তাটা কাঁচা ছিল ।
পাঁশে ছিল বাঁক ধরানো ঝিল ।
ভাঙা সমজিদ কিংবা কখনও টিনের চালা দেয়া ।
কাঁচা বাশের সাঁকো ,
থরথর করে কাঁপে -
নিথর মানব মনে ,
কখন যে সাকোর বাঁশ পাকবে
সাঁকো নিজেই জানে ।

সাঁকো জয় কবি গোস্বামী বলেন-
একটি বিচ্ছেদ থেকে পরের বিচ্ছেদে
যেতে যেতে 
কয়েকটি দিন মাত্র মাঝখানে পাতা আছে
মিলনের সাঁকো।

সাঁকো ও শৈশব স্মৃতি 
****************
সত্তর দশকে বাংলায় এমন কোন গ্রাম ছিলনা যেখানে বাঁশের সাঁকো ছিলনা। প্রতিটি গ্রামে সাত আটটি করে বাঁশের সাঁকো ছিলো। বর্ষার মৌসুমে খাল, বিল, নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়ার মাধ্যম ছিলো নৌকা এবং বাঁশের সাঁকো। খুব সহজে পারাপারের জন্য বাঁশের সাঁকো ছিলো ভালো মাধ্যম। বর্ষায় নদীর পানি বেড়ে গেলে গ্রামের ছোট বড় সম্মিলিতভাবে বাঁশ সংগ্রহ করে সাঁকো তৈরি করতেন। সেই সাঁকো দিয়ে পারাপার হতো বিভিন্ন পেশার মানুষ এমন কি ছোট ছোট বাচ্চারাও। তারা প্রতিনিয়ত সাঁকো ওপর দিয়ে স্কুল যেতে দুষ্টমি করে সাঁকো থেকে লাফ দিতো, পা পিছলে পানিতে পড়ে যেতো। সাহস জোগাতে একজন আরেক জনকে বলতো, দেখ এটা তো বাঁশের সাঁকো পুলসিরাতে তো চুলের সাঁকো পার হতে হবে, তা আরো কঠিন। আজ আর সাঁকো নেই, কালের চাহিদা মতো তা পাকা রাস্তা আর ব্রিজে পরিণত হয়েছে, কিন্তু সেই স্মৃতি গুলো আজও অম্লান হয়ে আছে, যা শৈশবকে মনে করে দেয়।

সাঁকো তৈরির উপকরণ  ও উদ্যোগ
***************************
পল্লীগ্রামে বর্ষা মৌসুমে যখন পানি বা কাঁদায় নদী, ছোট নদী, খাল পরিপূর্ণ থাকে তখন সেসব জায়গা দিয়ে সহজে পারাপার হওয়ার জন্য সাঁকো ব্যবহার করা হয়। সাঁকো সাধারণত বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়। বাঁশ ছাড়াও সাঁকো তৈরিতে বড় গাছের কাণ্ড বা ডাল, মোটা লোহার পানির পাইপ, কলাগাছ, মোটা দড়ি প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। সাঁকো তৈরিতে সব সময় অভিজ্ঞ মিস্ত্রির প্রয়োজন হয় না।  নিজেদের উদ্যোগেই গ্রামের কয়েকজন মিলে তৈরি করে ফেলতে পারে এক একটি বাঁশের সাঁকো। শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে যেসব এলাকায় খাল বা ঝিল আছে, সেখানে খাল বা ঝিল পারাপারের জন্য সাঁকো ব্যবহার করা হয়।

একটি সাঁকো তৈরি করতে অনেক বাঁশের প্রয়োজন হয়। তাই সাঁকো তৈরির উদ্যোক্তারা সেই গ্রাম বা মহল্লার সবার কাছ থেকে বাঁশ, দড়ি বা সাঁকো তৈরির প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বা অর্থ সংগ্রহ করত। তারপর সেগুলো একত্র করে বিশেষ একটি দিনে সবাই একযোগে কাজ করে খাল বা নদীর বুকে সাঁকো তৈরি করত। নদীর বুকের দুই পাশে সরু বাঁশ পুঁতে দুই বাঁশের মধ্যবর্তী স্থানে ঢালাওভাবে বাঁশ বেঁধে দেওয়া হয়। পারাপারের সুবিধার জন্য সাঁকোর ওপরের অংশে যেকোনো এক পাশে বা উভয় পাশে হাতল দেওয়া হয়। হাতল ধরে যে কেউ সহজে সাঁকো পার হতে পারে। তবে শহরাঞ্চলের যারা সাঁকো পারাপারে অভ্যস্ত নয়, তাদের অনেকে সাঁকো পার হতে খুব ভয় পায়।

শেষ কথা
******
বাঁশের সাঁকো গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য হলেও প্রতিনিয়ত থেকেই যায় ঝুঁকিপূর্ন।  প্রত্যান্ত অঞ্চলে নদী, খাল, বিল ও ঝিল পাড়ের মানুষ প্রয়োজের তাকিদে নিজ উদ্যোগে সহজে  যাতায়াতের জন্য সাঁকো  তৈরি করতেন। তারা সেই সাঁকো দিয়ে প্রতিনিয়ত  যাতায়াত করতেন। কালের বিবর্তনে বাঁশের সাঁকো হারিয়ে গেলেও আধুনিকতার ছোঁয়ায় ডিজিটাল যুগে উন্নয়নের ফলে অনেক জায়গায় অধিকাংশ নদী,খাল,খাল,হাউর,বাওর ইত্যাদি জলাশয়ে সাঁকোর পরিবর্তে পাকা ব্রিজেে ব্যবস্থা হয়েছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থাকে করে দিয়েছে সহজ থেকে সহজতর। যার ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লাঘব হয়েছে।

গ্রাম-গঞ্জের কিছু এলাকায় এখনো ছোট-খাটো বাঁশের সাঁকো থাকলেও অদূর ভবিষ্যতে বাঁশের সাঁকোর পরিবর্তে মানুষের যোগাযোগ অন্যতম মাধ্যম হবে পাকা পুল বা ব্রিজ।  সাঁকো কি জিনিস!  তা হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম চিনবেও না। হয়ত সাঁকো শব্দটি বইয়ের পাতায় থেকে যাবে স্মৃতি হয়ে।

লেখক : গবেষক ও গণমাধ্যম কর্মী। 


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল