এহসান রানা, ফরিদপুর প্রতিনিধি:
ফরিদপুরের সরকারী ও বেসরকারী কয়েকটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে বিতর্কিত কিছু কর্মকান্ডের কারণে দেশজুড়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। স্বাস্থ্য নগরী হিসাবে দক্ষিনাঞ্চলের জেলা ফরিদপুরকে ধরা হলেও সেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একেবারেই নাজুক। স্বাস্থ্য বিভাগের নজরদারী না থাকা এবং এ দপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তার দুর্নীতির কারণে চিকিৎসা সেবায় হাসপাতাল ও ক্লিনিক গুলো বেহাল দশায় পরিনত হয়েছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা এসব প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার গুলোর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু রহস্যজনক কারনে অবৈধ ভাবে গড়ে উঠা এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক গুলোতে অভিযান না চালানোর কারনেই একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক গুলোতে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনার বিষয় নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ফরিদপুরের নামকরা বেশ কয়েকটি হাসপাতালে রোগীর ভুল চিকিৎসা নিয়ে অভিযোগ থাকলেও সেগুলোকে নানাভাবে ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না রেখে আয়া নার্স দিয়ে অপারেশনের মতো কাজ চালানোর প্রমান মিলেছে। ভুল চিকিৎসার কারনে রোগীরা দূর্ঘটনার শিকার হওয়ার পর সমালোচনা শুরু হলে নড়েচড়ে বসে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ। এরই মধ্যে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দুটি প্রাইভেট হাসপাতাল ও দুটি ডায়াগনষ্টিক সেন্টার।
ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে মনিরা নামের এক রোগীকে অপারেশন করা হয় ২০২০ সালে। সেই সময় চিকিৎসকের ভুলে মনিরার পেটে কাঁচি রেখে সেলাই করে দেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘ দুই বছর পর বিষয়টি ধরা পড়ার পর গত ১০ ডিসেম্বর অপারেশনের মাধ্যমে মনিরা পেট থেকে বড় আকারের একটি সার্জারী কাঁচি বের করা হয়। এ নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ১৫ জানুয়ারী শহরের পশ্চিম খাবাসপুর এলাকায় অবস্থিত আল মদিনা নামের একটি হাসপাতালে আয়া দিয়ে সিজার করতে গিয়ে এক প্রসূতির নবজাতকের কপাল কেটে ফেলা হয়। সেই নবজাতকের কপালে ৯টি সেলাই করেন সেই আয়া নিজেই। এ নিয়ে হাসপাতাল কতৃপক্ষ রোগীর স্বজনদের নানা ভয়ভীতি দেখান বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য। পরে রোগীর স্বজনেরা জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনকে অবহিত করলে সেখানে ছুটে যান সিভিল সার্জন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার। সেখানে গিয়ে তারা ঘটনার সত্যতা পান। পরে সেই আল মদিনা হাসপাতালটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। মামলা দেওয়া হয় হাসপাতালটির পরিচালকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে।
এদের মধ্যে হাসপাতালের পরিচালক, আয়াসহ তিনজনকে আটক করে পুলিশ। বর্তমানে তারা জেলহাজতে রয়েছেন। এ ঘটনার পর শহরের আরামবাগ নামের আরেকটি প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এক নবজাতকের হাত ভেঙে ফেলার অভিযোগ উঠে। নবজাতকের পিতা আরিফুল আলম সজল জানান, গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর আরামবাগ হাসপাতালে তার স্ত্রীকে সিজারের জন্য নেওয়া হয়। সেই সময় চিকিৎসক শারমিন সুলতানা জুই নবজাতকের হাত ভেঙে ফেলে। বিষয়টি তারা তখন জানতে পারেননি। পরে শিশুটির হাতের অবস্থা খারাপ হলে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসককে দেখান এবং এক্সরে করলে হাত ভাঙার ঘটনাটি ধরা পড়ে। এ নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা বিভিন্ন ভাবে হুমকি দিয়ে ঘটনাটি চেপে যেতে বলেন। কিন্তু আরিফুল আলম সজল এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে হাসপাতালটিতে অভিযান চালায় স্বাস্থ্য বিভাগ। গত ১৯ জানুয়ারি আরামবাগ নামের হাসপাতালটিতে অভিযান চালিয়ে ডিগ্রিধারী চিকিৎসক ও বৈধ কাগজপত্র না থাকায় হাসপাতালটি বন্ধ করে দেন সিভিল সার্জন ডা. মোঃ ছিদ্দীকুর রহমান। অভিযানকালে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানতে পারেন হাসপাতালের সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে শারমিন সুলতানা জুই ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। কিন্তু তিনি কখনোই বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাকরি করেননি। ভুয়া নাম ব্যবহার করে তিনি আরামবাগ হাসপাতালটিতে প্রসূতিদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছিলেন। এই হাসপাতালটির বিরুদ্ধে এর আগে একাধিক অভিযোগ থাকায় ভ্রাম্যমান আদালত অভিযান পরিচালনা করে। হাসপাতাল কতৃপক্ষ ভুল স্বীকার করায় সেই সময় মৌখিক ভাবে সতর্ক করা হয়। অভিযানের সময় দুটি হাসপাতালের সংশ্লিষ্টরা কৌশলে সরে পড়েন। পরপর বেশ কয়েকটি ঘটনায় বেশ সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
ফরিদপুর জেলা সদর ছাড়াও ভাঙ্গায় একাধিক ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া বোয়ালমারী, মধুখালী, আলফাডাঙ্গা, চরভদ্রাসন উপজেলার বেশীর ভাগ ক্লিনিক গুলোর বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসাসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফরিদপুর জেলা সদরে সরকারী দুটি হাসপাতাল রয়েছে। তাছাড়া ৯টি উপজেলায় রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এছাড়া ডায়াবেটিক হাসপাতাল, হার্ট ফাউন্ডেশন, শিশু হাসপাতালসহ ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় দুই শতাধিক প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক গুলোর বেশীর ভাগই নেই বৈধতা। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা এসব ক্লিনিক ও হাসপাতাল গুলোতে চিকিৎসা সেবার নেই প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও চিকিৎসক। বাড়ী ভাড়া নিয়ে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই চালানো হচ্ছে এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক। শহরের বেশ কয়েকজন নাগরিক অভিযোগ করে বলেন, জেলায় বড় দুটি সরকারী হাসপাতাল থাকলেও সেই হাসপাতালের চিকিৎসকেরা হাসপাতালে না থেকে বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে সময় দেন। আর ইন্টানী চিকিৎসকেরা চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। ফলে তেমন কোন চিকিৎসা সেবাই পাওয়া যায়না এই হাসপাতাল দুটিতে। আর দালালদের কারনে তেমন কেউ সরকারী হাসপাতালে যেতেই পারেন না। বিভিন্ন জেলা ও গ্রাম গঞ্জ থেকে রোগীরা এলে দালালেরা তাদের স্বজনদের ভুল বুঝিয়ে নিয়ে যান ক্লিনিক ও হাসপাতাল গুলোতে। স্বাস্থ্য বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তারা প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার গুলো থেকে মাসোয়ারা নিয়ে থাকেন। ফলে বৈধ কাগজপত্র ও কোন নিয়ম নীতির ধারও ধারেন না হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকেরা।
ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক পান্না বালা বলেন, জেলাজুড়ে যেসব প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক গুলো রয়েছে তার বেশীর ভাগেরই কোন বৈধতা নেই। সব হাসপাতাল ও ক্লিনিক গুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নাম লিখে রাখা হয়। যাতে রোগী ও তাদের স্বজনেরা প্রলুব্দ হয়। আর এসব হাসপাতালে নেই কোন চিকিৎসা সরঞ্জাম। আয়া ও নার্স দিয়েই পরিচালিত হয় বেশীর ভাগ হাসপাতাল। এগুলো বন্ধ করতে হবে। নইলে ভুল চিকিৎসায় অকালে ঝড়ে যাবে মানুষের প্রান। নারীনেত্রী শিপ্রা গোস্বামী বলেন, হাসপাতাল গুলোতে চিকিৎসা সেবা নেই বললেই চলে। সেখানে বিভিন্ন সাইনবোর্ড গুলোতে দেখা যায় অনেক চিকিৎসকের নাম। প্রায় প্রতিটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গুলোতে একই চিকিৎসকের নাম ব্যবহার করে থাকে। একজন চিকিৎসক একই সময়ে কয়টি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেবার জন্য থাকতে পারেন তা আমাদের বোধগম্য নয়।
বুধবার ( ২৬ জানুয়ারি ) ফরিদপুরে এক গৃহবধূকে প্রাইভেট ক্লিনিকে এপেন্ডিক্স অপারেশনের সময় মলদ্বারের নাড়ি কেটে ফেলার ঘটনায় শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের পাশে অবস্থিত পিয়ারলেস হাসপাতালের দুই পরিচালককে সাত দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।রাত ৮টার দিকে ফরিদপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এস এম ইমরাজিন টুনুর নেতৃত্বে পরিচালিত আদালত এ কারাদণ্ড দেন। দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- পিয়ারলেস হাসপাতালের পরিচালক মিঠুন চন্দ্র সরকার ও আসাদুজ্জামান আসাদ।
সিভিল সার্জন ডা. মোঃ ছিদ্দীকুর রহমান বলেন, ফরিদপুরে যেসব প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের বৈধ কাগজপত্র এবং নিয়ম নীতির বাইরে রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। এ বিষয়ে আমরা অভিযান শুরু করে দিয়েছি। এরই মধ্যে দুটি প্রাইভেট হাসপাতাল ও দুটি ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক গুলোর বিরুদ্ধে এবার জিহাদে নেমেছি।
এমআই