সুজন মাঝি (পল্লী কবিতা)
- ডা. আফতাব হোসেন
সাঁঝ নেমেছে, একলা মেয়ে, পরে সবুজ শাড়ি,
যাচ্ছ কোথায় ডিঙ্গি বেয়ে, কোথায় তোমার বাড়ি ?
কোমল হাতে বৈঠা কেন? থাকবে রেশমি চুড়ি,
কোঁচড় ভরে খাওয়ার কথা নলেন গুড় আর মুড়ি।
ওই যে হোথায়, গাছের ছায়ায়, হিজলতলী গাঁও,
ওই খানেতে বাপের বাড়ি, জানতে কেন চাও ?
কুঁচের বরণ রঙ যে তোমার, কাজল কালো আঁখি,
কোন বা নামে ডাকি কন্যা, জলপরী না পাখি?
লাজে মরে গাঁয়ের মেয়ে, শরম চোখে চায়,
বাবরি চুলের জোয়ান মাঝি বসে আছে নায়।
শুধাও কেন এ সব কথা, দেখি নাই তো আগে?
শুনলে কথা পরপুরুষের, মনেতে ভয় জাগে।
ভয় পেও না জলের মেয়ে, আমি জলের মাঝি,
বাণিজ্যেতে আসছি হেথায়, নই তো মানুষ পাজী।
রুপোর মল আর পুঁতির মালা, আছে ঢাকাই শাড়ি,
আরও বেচি চুলের ফিতে ঘুরে বাড়ি বাড়ি।
পদ্ম পায়ের আলতা আছে, মেহদী রাঙ্গা হাতে
পরিয়ে দেব কাঁচের চুড়ি, যাও যদি মোর সাথে।
পাতার মতো কাঁপে মেয়ে অজানা এক সুখে,
লাগছে ভালো শুনতে কথা অচিন মাঝির মুখে।
কোথা হতে এলে মাঝি, কোথায় তোমার ঘর?
কোন সাহসে বলছ এ সব, নাই কি তোমার ডর?
মাতুব্বরের মেয়ে আমি, সাত গেরামের সেরা,
চারিদিকে আছে বাপের পাইক পেয়াদা ঘেরা।
ভুলেও যদি আমার দিকে তাকাও চক্ষু তুলে,
অকারণে প্রাণ হারাবে, চড়ায় দেবে শূলে।
যাও ফিরে যাও মায়ের ছেলে, যাও ফিরে তাঁর বুকে,
নিজের দেশে শাদী করে থাকো মনের সুখে।
ভাঁটির দেশের মাঝি আমি, নেইকো প্রাণে ডর,
নদীর বুকে নৌকা ভাসাই, যতই উঠুক ঝড়।
ঢেউয়ের সাথে পাঞ্জা লড়ি, স্রোতের উজান চলি,
শক্ত হাতে বৈঠা ধরি, সত্য কথা বলি।
তোমায় দেখে প্রাণ সঁপেছি, দিয়েছি এই মন,
বঁধু করেই ফিরব ঘরে, এই করেছি পণ।
শিউরে ওঠে সরল মেয়ে শুনে মাঝির কথা,
উজান গাঁয়ে জটিল নিয়ম, কঠিন গাঁয়ের প্রথা।
অনেক টাকা পণ দিতে হয়, লাগে গয়না-গাটি,
থাকতে হয় যে ধানের জমি, টিনের বসত-বাটি।
সোনার মেয়ে, সোনার দামে নেবো তোমায় কিনে,
ভাবতে নারি এমন জীবন বাঁচতে তোমায় বিনে।
এই গাঁয়েতে কিনব জমিন, গড়ব টিনের বাড়ি,
পালকি চড়ে আসবে পরে বেনারসি শাড়ি।
ঈশান কোনে মেঘ করেছে, ডাকছে গুরুগুরু,
যাও ফিরে যাও নদীর মেয়ে, বাদল হবে শুরু।
কেমনে যাব বাড়ি ফিরে ? ওগো সুজন মাঝি,
পাইনি খুঁজে সিঁথি হাঁস মোর, হইছে ভীষণ পাজী !
বাকি হাঁস সব আসলো ঘরে, সিঁথিটা মোর কই?
কত করে ডাকলাম তারে, আয় ফিরে তই তই।
কথা দিলাম কাজল মেয়ে, খুঁজব তোমার হাঁসা,
পৌঁছে দেব তোমার কাছে তোমার ভালোবাসা।
আসব নিয়ে বিয়ের পয়গাম তোমার বাপের কাছে,
তুলে দেবে টাকা পয়সা যা কিছু মোর আছে।
খুশি হয়ে চলল ফিরে ঘুরিয়ে ডিঙ্গি নাও,
লজ্জাবতী মেয়ের মনে লাগল ফাগুণ বাও।
বাড়ি ফিরে দেখে যে তার দুষ্টু সিঁথি হাঁসে,
চুপটি করে আছে বসে ঘরের দাওয়ার পাশে।
খুশির চেয়ে কষ্ট বেশি পল্লীবালার মনে,
ঘুরছে কোথায় প্রাণের মাঝি, নদীতে না বনে ?
তবু হাতে মেহদী রাঙায়, চোখে কাজল পুরু,
কুসুম ফোটা বুকটি যে তার কাঁপছে দুরুদুরু।
পান খেয়ে ঠোঁট রঙিন করে, ফিতেয় বাঁধে চুল,
নাকে নথ আর মাজায় বিছা, কানে পরে দুল।
যাও উড়ে যাও বনের পাখি, বলো মাঝির কানে,
আকুল হয়ে আছি চেয়ে তাহার পথের পানে।
আঁধার করে সন্ধ্যা নামে, বাতাসের বেগ বাড়ে,
মুষল ধারায় বৃষ্টি নামে, গাছ নুয়ে যায় ভারে।
ফুঁসে ওঠে তিস্তা নদী, স্রোতে দু’কুল ভাঙ্গে,
উথাল পাতাল ঢেউয়ের মাঝে একলা মাঝি গাঙ্গে।
পায় না খুঁজে হাঁস যে মেয়ের, পায় না খুঁজে কুল,
কোন মুখেতে ফিরবে মাঝি, যদি বোঝে ভুল?
কথা দিয়ে কথা রাখা, ভাঁটির দেশের রীতি,
জান দেবে তো মান দেবে না, নাই জীবনের ভীতি।
বৈঠা ছেড়ে হতাশ মাঝি আকাশ পানে দেখে,
আজদাহা মেঘ আসছে ধেয়ে মুখে কালি মেখে।
হঠাৎ মাঝির রঙিন ভুবন হয় যে নিকষ কালো,
উলটে যায় তার জীবন তরী, নেভে চোখের আলো।
ডুবতে ডুবতে ভাঁটির মাঝি আপন মনে বলে,
ললাট লিখন না যায় খণ্ডন, যেতে হচ্ছে চলে!
যাবার আগে একটা দুঃখ রইল মনের মাঝে,
না পেলাম প্রেম অচিন মেয়ের, না এলাম তার কাজে!
খুলনা।
৩০ জানুয়ারি ২০২২।