ড. নাদিম মাহমুদ :
গত কয়েকদিন ধরে ‘নিওকভ (NeoCoV)’ নিয়ে বাংলাদেশের ও ভারতের সংবাদ মাধ্যম যা লিখলো, তা দেখে সত্যি হতাশ। এই ধরনের ভুল-ভাল নিউজ পরিবেশন করে মানুষের মনে কেবল আতঙ্ক তৈরি করা গেছে, যা সাংবাদিকতার নীতির সাথে যায় না।
প্রথমত, ‘নিওকভ’ নতুন কোন ভাইরাস নয় এটি ২০১১ সালের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রদেশের ৬২ বাদুড় থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়, পরবর্তী তারা জিনম সিকুয়েন্স করে Neoromicia cf. zuluensis প্রজাতির বাদুড়ের শরীরে নতুন একটি ভাইরাস দেখতে পান, তার নাম দেন PML/2011। এটি পরবর্তীতে আন্তজার্তিক ভাইরাস নামকরণ কমিটি (আইসিটিভি) নিওকভ নাম দেয়। এই ভাইরাসটি মূলত মধ্যপাচ্যে প্রাপ্ত MERS-CoV জিনম সিকুয়েন্সের সাথে ৮৫ শতাংশ মিল পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, নিওকভকে গণমাধ্যমে সার্স-কভ-২ করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন, যা আদৌও সঠিক নয়। সার্স-কভ-২ সাথে নিওকভের যোজন যোজন দূরত্বের সম্পর্ক। এটাকে এক কাতারে নেয়ার কোন সুযোগ নেই।
মার্স ও সার্স এই দুই করোনা ভাইরাসের মূল পার্থক্য হলো, এরা দু’টি নিদিষ্ট পৃথক পৃথক গ্রাহক বা রিসেপ্টরের মাধ্যমে পোষকের দেহে প্রবেশ করতে পারে। মার্স মূলত ডাইপেপটাইডাল পেপটাইডেজ ৪ (DPP4) রিসেপ্টরের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়। আর অন্যদিকে সার্স ভাইরাস এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ (এসিই২) মাধ্যমে কোষে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়।
নিওকভের মত আরো কিছু করোনাভাইরাস আবিস্কার হলেও এদের বিষয়ে তেমন গবেষণা হয়নি। চীনের উহানের গবেষকরা গত ২৫ জানুয়ারি প্রি-প্রিন্ট জার্নাল বায়োর্কাভ ‘Close relatives of MERS-CoV in bats use ACE2 as their functional receptors’ শিরোনামে যে গবেষণাপত্রটি আপলোড করেছে, সেখানে তারা বলছে, নিওকভ এবং PDF-2180-CoV র জিনম সিকুয়েন্সে মার্স-কভ সাথে মিল থাকলেও নিওকভ মার্স মত ডাইপেপটাইডাল পেপটাইডেজ ৪ মাধ্যমে কোষে প্রবেশ করতে পারছে না। তার কারণ, এই করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের গ্রাহকের সাথে লেগে থাকা প্রোটিন অংশ (যাকে আমরা আরবিডি বলি) কিছুটা স্বতন্ত্র। এই গবেষকদল প্রত্যাশিতভাবে দেখতে পান, নিওকভ বাদুড়ের শরীর থেকে প্রাপ্ত এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ (এসিই২) গ্রাহকের মাধ্যমে কোষে প্রবেশ করতে পারে। তবে মানুষের শরীরে প্রাপ্ত এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ (এসিই২) মাধ্যমে এই দুই ভাইরাস কোষে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে এখন পর্যন্ত এইসব করোনাভাইরাস দ্বারা কেউ আক্রান্ত হয়নি। তবে এই গবেষকদল যখন নিওকভের মধ্যে রিসেপ্টের বাইন্ডিং মটিফের একটি মিউটেশন ঘটিয়েছে, তখন কেবল এই ভাইরাস কোষে সংক্রমণ ঘটাতে পারে । তবে সেটি কেবল ল্যাবরেটরিতে নিদিষ্ট পরীক্ষায় তারা এই ফল দেখতে পেয়েছে।
নিওকভের মত কয়েক ডজন করোনাভাইরাস আছে। সব করোনাভাইরাস সংক্রমণশীল নয়। আমরা চাইলে, এইসব করোনা ভাইরাস নিয়ে মিউটেশন ঘটিয়ে হাজারো ভ্যারিয়েন্ট আমরা গবেষণাগারে তৈরি করতে পারি, তার মানে এই নয়, এই ভ্যারিয়েন্ট সব মানুষকে মেরে ফেলতে পারে। তার মানে এই নয় যে, নিওকভ নামক নতুন করোনাভাইরাস মানুষকে গ্রাস করছে। সার্স-মার্স, জিকা এইসব চলমান গবেষণা। আর এরই অংশ হিসেবে নিওকভের নতুন একটি ফাইন্ডিং পাওয়া গিয়েছে, যা থেকে গবেষকরা নতুন তথ্য পেল। দ্যাটস দ্যা স্টোরি।
এর বাহিরে এটি নিয়ে মাতামাতির তেমন কিছু নেই। গুজব ছড়ানোর কিছু নেই। সংবাদমাধ্যমগুলোর আরও একটু দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত। ভারতের কোন গণমাধ্যমে কেউ একটা স্টোরি করলেই যে আমাদেরও ঝাঁকে ঝাঁকে নিউজ করতে হবে, এর কোন হেতু নেই। এইসব ক্লিকবাইটের নেশা বন্ধ হোক।
লেখক :পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েটস, ওসাকা ইউনিভার্সিটি, জাপান।