ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি: ঘরের দরজা খুলতেই টর্চলাইটের আলোতে দেখা গেল এক মানবেতর চিত্র। যে ঘরে ফরিদ ইসলাম থাকে ওই ঘরে তিনটি ছাগল ও একটি গরুও থাকে। একটি মাত্র চৌকি। চৌকিতে ঘুমিয়ে স্ত্রী সহ সন্তানরা। পাশে বসেই রাত কাটাবে ফরিদ। কোন বিদ্যুৎ সংযোগ। বিদ্যুতের বিপ্লবের যুগে ফরিদের সাঝবাতি নব্বই দশকের হারিকেন। গরু,ছাগলের সাথে স্ত্রী, সন্তান নিয়ে এভাবেই দিনাতিপাত করে আসছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ফরিদ হোসেন।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের ০৯ নাম্বার ওয়ার্ডের মুন্সিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ফরিদ হোসেন।
জানা যায়, মাত্র দু'বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চোখের দৃষ্টি হারান ফরিদ হোসেন। ছোটবেলা থেকে অন্যের সহযোগিতা নিয়ে পথ চলতে হত তাকে৷ পরে আবছা আন্দাজের উপর জীবন যাপন করছেন তিনি৷ পেশা হিসেবে শাক বিক্রি করেন তিনি। স্ত্রী নাজমা বেগন কাজ করেন অন্যের বাসায়৷ যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে তার৷ চার সন্তানের বাবা তিনি। দুটি ছেলে ও দুটি মেয়ে তার৷ বড় মেয়ের বয়স ১১ বছর পড়ছেন সপ্তম শ্রেণীতে৷ আর তিন সন্তানও আছে তার৷
প্রতিবেশী সেলিনা বেগম বলেন, দুইটি হাড়ি, দুইটি গ্লাস ও তিনটি প্লেটে ফরিদের ঘরের অবস্থা। খুব কষ্ট করে ওরা দিন রাত পার করে তারা। সব সময় হাসিখুশী থাকলেও রাতে ফরিদ ঘুমায়না। একা একা রাস্তায় পায়চারি করে। ফরিদের জন্য খুব কষ্ট হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মাসুদ রানা বলেন, ফরিদ ধামির্ক ছেলে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। অন্ধ হয়েও সে ভিক্ষা করেনা। সম্মান নিয়ে সে চলতে পারে। সরকার তাকে সামান্য সহযোগিতা করলেও সে সম্মান নিয়ে বাঁচতে পাড়বে। তাকে সরকার থেকে একটি বাড়ির ব্যবস্থা ফরিদ নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমাতে পারবে।
ফরিদের স্ত্রী নাজমা বেগম বলেন, অন্ধ স্বামী ও চার সন্তান নিয়ে অনেক কষ্ট করে জীবন চালাতে হয় আমাকে। একটা ঘরেই গরু, ছাগলসহ দিন কাটে আমাদের। আমি চাই যাতে করে আমাদের সন্তানেরা ভালভাবে পড়াশুনা করে মানুষের মত মানুষ হতে পারেন৷ আমার সন্তানদের পড়াশোনা করার জন্য সবার সহযোগিতা চাই৷
ফরিদ হোসেন বলেন, ছোটবেলায় আমি আমার দৃষ্টি হারাই। তারপর থেকেই আবছা আর অনুমান করে জীবন চালাই। আমার তিন সন্তান আছে। বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। আর বাকী দু সন্তান ছোট। সংসার জীবনে শাক বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়েই চালাতে হয়৷ আমি কিভাবে আমার সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করব এটাই ভাবি। আমি যে কষ্টে জীবন যাপন করছি তারা যেন ভালভাবে পড়াশুনা করে বড় কিছু করতে পারে৷
তিনি আরও বলেন, আমি একজন অন্ধ মানুষ। কিন্তু আমার ঘরে আমার স্ত্রী-সন্তানরা কতটা কষ্টে থাকে তা উপলব্ধি করতে পারি। আমার ঘরে এক খাটের উপর সকলকে ঘুমাতে হয়। শীত নিবারনের জন্যও নেই তেমন শীতবস্ত্র। একটু বৃষ্টি হলেই ঘরে পানি জমে থাকে। মাটির ঘরটি অনেক পুরোনো। কখন ভেঙ্গে পড়ে স্বপরিবারে মারা যাই ঠিক নেই। আমি রাত-ভোর রাস্তায় হাটাহাটি করি। ঘুম আসেনা। ঘরে মাটিতে একটু ঘুমাবো তাও সম্ভব না। গরু-ছাগলের মলমূত্র-দূর্গন্ধ গায়ে মেখে এভাবেই থাকতে হয়। বিশ্বাস না হলে আমার ঘরটা দেখে যান। আমি অসহায়। আমার ঘর বানানোর স্বামর্থ নেই। যদি চোখে দেখতে পারতাম তাহলে জঙ্গলেও একটা ঘর দিলে আমি পরিবার নিয়ে থাকতে পারতাম।
সামাজিক সেচ্ছাসেবী সংগঠন হেল্প ঠাকুরগাঁও এর সভাপতি লাভলী আক্তার বলেন, ফরিদ হোসেনের বিষয়টি অনেক কষ্টের৷ এক ঘরে গরু, ছাগলের সাথে বসবাস করা আসলেই কষ্টসাধ্য। আমরা তার পরিবারের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ কে অনুরোধ করছি। আমরা হেল্প সোসাইটির পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করব। তার সন্তানেরা যাতে করে পড়াশোনা করতে পারে সেজন্য সহযোগীতা করব৷ সেই সাথে যারা সমাজের বিত্তবান মানুষেরা আছেন তাদের সকলে এগিয়ে আসার আহবান করছি৷
ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য কুলুরাম রায় বলেন, ফরিদকে গুচ্ছগ্রামে একটি ঘর দিতে চেয়েছিলাম। ফরিদ বলেছিল ওখানে সে চলাফেরা করতে পারবেনা। পরে ভেবে দেখলাম অন্য কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা। তবে ফরিদের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করা জরুরি।
আকচা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুব্রত কুমর বর্মন বলেন, ফরিদ হোসেন একজ অন্ধ মানুষ৷ আমরা তাকে প্রতিবন্ধী কার্ড সহ যে স্থানীয় সুযোগ সুবিধা আছে তা দেওয়ার চেষ্টা করি। আর ঘরের জন্য হলে তাকে ইউএনও অফিস বা ডিসি অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। আমরা তাকে স্থানীয় সরকারের যে সুযোগ সুবিধা আছে আমরা তাকে দিব৷
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মোঃ শামসুজ্জামান বলেন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ফরিদের বিষয়টি আমাদের গোচরে এসেছে৷ তাকে যেসকল সরকারি সুযোগ সুবিধা দেওয়া দরকার তা প্রদান করা হবে৷
সময় জার্নাল/আরইউ