মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান :
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশের সংখ্যা মোট ২৭ এবং ন্যাটোভুক্ত দেশের সংখ্যা মোট ৩০। এই ২৭ এবং ৩০ এর কোন দেশের মধ্যে ইউক্রেন অন্তর্ভুক্ত নয়। যদিও এসটোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ন্যাটোভুক্ত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশ। এই তিনটি দেশের সঙ্গে রাশিয়ার স্থল সীমান্ত রয়েছে এবং রাশিয়ার ঠিক নাকের ডগায় এই দেশ তিনটির অবস্থান। একই ভাবে ইউক্রেনের সাথেও রাশিয়ার স্থল সীমান্ত রয়েছে এবং এই দেশটির অবস্থানও রাশিয়ার নাকের ডগায়।
ক্রাইমিয়া পেনিনসুলার অবস্থান ইউক্রেনের নিচে। ২০১৪ সালে ২৬ শে ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ক্রাইমিয়া পেনিনসুলা দখল করে রাশিয়ার অংশ করে নেয়।
ভলোদোমির ওলেসান্দ্রভিচ জেলেনষ্কি ২০১৯ সালে ইউক্রেনের ষষ্ঠতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইউক্রেনের ক্ষমতা গ্ৰহনের পর ইউক্রেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো সদস্য ভুক্ত দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিলে রাশিয়ার পক্ষ থেকে এর জোর প্রতিবাদ করা হয়। হুমকি দেয়া হয় ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণের। ইউক্রেন একটি ইউরোপীয় দেশ। পূর্ব ইউরোপে এর অবস্থান। ইউক্রেন গনতন্ত্রিকদেশ। একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে সে দেশের মানুষ তাদের দেশের মঙ্গলের জন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। ইউক্রেনের এই সিদ্ধান্ত কৌশলগতভাবে রাশিয়ার পছন্দ হয়নি। কারণ ইউক্রেন ন্যাটো ভুক্ত দেশ হলে রাশিয়ার সীমান্তে ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঘটবে। ইউক্রেনকে রাশিয়া কর্তৃক ন্যাটোর সদস্য ভুক্ত হওয়া থেকে বিরত করতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে রাশিয়া শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন আক্রমণ করে বসে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ যে যুদ্ধ এখন চলমান। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো রাশিয়া তার পারমাণবিক অস্ত্র সমূহকে প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণকে কেন্দ্র করে বিশ্ব জনমত একটি প্লাটফর্মে এসে দন্ডায়মান হয়েছে। বিপক্ষে রয়েছে চীন, ভারত ও ইউ এ ই।
রাশিয়ার সীমান্তে ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঘটবে এই যুক্তিকে ভিত্তি করে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে যদি আমরা সমর্থন করি তাহলে বিশ্বের ছোট ছোট দেশগুলির নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হবে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশ চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে ভারত এই যুক্তিকে কাজে লাগিয়ে হয়তো একদিন ইউক্রেনের মত বাংলাদেশ আক্রমণ করে বসতে পারে। কারণ বাংলাদেশের অবস্থান চীন এবং ভারতের মধ্যস্থলে। কিংবা যুক্তি খাড়া করতে পারে যে ইউক্রেনের মত বাংলাদেশও একসময় ভারতের অংশ ছিল। অতএব বাংলাদেশ দখল করা যেতে পারে। এটা হলে সারা বিশ্ব ছোট বড় দেশ মিলে যুদ্ধে নিমজ্জিত হবে। এটা হতে দেওয়া যায় না।
আজকে যদি আমরা বিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে দেখব বিশ্ব দুইটি আদর্শের উপর ভিত্তি করে বিভাজিত হয়ে আছে। একদিকে ক্যাপিটালিজম অপরদিকে কমিউনিজম। যদিও চীন এবং রাশিয়া বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করার সাথে কেপিটালিস্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে কমিউনিস্ট ব্যবস্থার মধ্যে সন্নিবেশিত করেছে তার পরেও চীন এবং রাশিয়া কমিউনিস্ট ও সোশালিস্ট আদর্শে শাসিত হচ্ছে একদলীয়ভাবে। ইউক্রেন দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে রাশিয়া যদি সমস্ত ইউরোপের উপরে প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয় তাহলে সারাবিশ্বে কমিউনিস্ট ও সোশালিষ্ট আদর্শ চেপে বসবে। যদি আমরা চীন এবং রাশিয়ার দিকে তাকাই তাহলে দেখব কমিউনিস্ট এবং সোশালিস্ট আদর্শিক ভাবে পরিচালিত/ শাসিত চীন ও রাশিয়াতে স্বাধীন ভাবে চলাফেরা ও স্বাধীন মত প্রকাশের কোন সুযোগ নাই। ধর্ম পালনের স্বাধীনতাও সেখানে চরমভাবে খর্বিত। মুসলমান প্রধান চীনের শিনজিয়াং প্রদেশ এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনস্থ মধ্য এশিয়ার মুসলমান দেশ সমূহ রাশিয়ার কমিউনিস্ট শাসনে থাকার সময় তাদের ধর্ম পালনের কোন স্বাধীনতা ছিল না। তারা নামাজ পড়া ভুলে গিয়েছিল এবং ধর্মীয় অনুশাসন থেকে তারা অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। এর মধ্যেও যারা ধর্ম পালনের চেষ্টা করেছিল তারা রাশিয়ার শাসকদের হাতে চরমভাবে অত্যাচারিত ও নিগৃহীত হয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে মধ্য এশিয়ার মুসলমান দেশ গুলি স্বাধীনতা লাভ করে। আজও এতদিন পর মধ্য এশিয়ার মুসলমানরা তাদের ধর্ম সম্বন্ধে কম ওয়াকেবহাল ও উদাসীন। অথচ নবী মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পরে সাহাবী ও তাবে তাবেঈনদের সময়ে ইসলামের সবচেয়ে বড় খেদমত এই মধ্য এশিয়ার মুসলমানরাই করেছিলেন। সহি হাদিস গ্রন্থ বুখারী শরীফ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
উপরে যেমন বলেছি বিশ্ব দুই শিবিরে আদর্শিক ভাবে বিভক্ত। এই দুই শিবিরের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য বজায় থাকা বিশ্ব শান্তির জন্য অপরিহার্য। যেমন ভারত / এশিয়া উপমহাদেশে চীন ও ভারতের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য এই দুই শক্তির মধ্যস্থিত দেশ সমূহের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য অতীব জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদিও ক্যাপিটালিস্ট, বাজার অর্থনীতির এবং গনতান্ত্রীক দেশ সমূহ যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকা ধোয়া তুলসী পাতা নয়। এরা যেমন বর্ণবাদী তেমনি ইসলামোফোবিষ্ট। এরা অধুনা অতীতে ইরাক, আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়াকে যেমন ধ্বংস করেছে তেমনি দেশে দেশে তাদের কৃষ্টি, কালচার, ডেমোক্রেসি এমন অনেক বিষয় চাপিয়ে দেয়, দিয়েছে ও দিচ্ছে। এরা সন্ত্রাসি এবং মানবতার দুশমন ইসরাইলের বড় সমর্থক ও অর্থ সহায়তাকারী। এর পরেও বলবো বিশ্বে মুক্তভাবে চলাচল, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নিজ ধর্ম পালন ও ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা এবং ধর্ম প্রচারের স্বধীনতা এই সব দেশ নিশ্চিত করে। বিতাড়িত, নিগৃহীত ও অত্যাচারিত মুসলমানদের এরাই আশ্রয় দেয়। অধুনা নিউজিল্যান্ড এবং কানাডা মুসলমানদের আশ্রয়স্থল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই সব দেশে এখনও আইনের শাসন ও মানবাধিকার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
ইউক্রেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অর্থডক্স একটা বড় সংখ্যালঘু অংশ ক্যাথলিক খ্রিস্টান। অল্প সংখ্যক ইহুদি ও মুসলমান। ইসরাইলের একটি গুপ্ত পরিকল্পনা হলো ইউরোপে পারমাণবিক যুদ্ধ সংঘটিত করে ইউরোপকে ধ্বংস করে দেওয়া। পরে আমেরিকাকে পিছনে ফেলে বিশ্বশক্তি হয়ে আবির্ভূত হওয়া। ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলোদোমির জেলেনস্কি একজন ইহুদি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে দিয়ে ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্য হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাশিয়াকে চটিয়ে ইউক্রেন আক্রমণ করতে প্ররোচিত করার পিছনে ইসরাইলের কোন ষড়যন্ত্র আছে কিনা সময় তা বলবে। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার দেশের পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুত করার যে ঘোষণা দিয়েছে তা একটি সাংঘাতিক ব্যাপার সারা বিশ্বের জন্য। এর পিছনেও ইসরাইলের কোন ষড়যন্ত্র আছে কিনা হয়তো একদিন বিশ্ব জানতে পারবে। আমরা দৃঢ় ভাবে আশা করি ইউক্রেন আক্রমণের মধ্য দিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু কিংবা পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার হবে না। যদি হয় তাহলে ইসরাইল বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
পরিশেষে বলব যতদিন পর্যন্ত না মুসলিম বিশ্ব তৃতীয় বিশ্ব শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত বর্তমান আদর্শিকভাবে বিভাজিত বিশ্বব্যবস্থার মধ্যেই আমাদেরকে থাকতে হবে।