মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান :
আজ পর্যন্ত যত যুদ্ধ হয়েছে তার পিছনে অর্থনৈতিক কারণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। কিন্তু একুশ শতকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে একথা বলা খুব মুশকিল যে যুদ্ধ কেবল অর্থনৈতিক কারণেই হয়? আজকে আমাদের সামনে যে বিষয়টি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য তা হল বিশ্বব্যবস্থা বা ওয়ার্ল্ড অর্ডার। এই ওয়ার্ল্ড অর্ডার বিশ্বব্যবস্থা যারা নির্ধারণ করেন সেই দেশ বা দেশসমূহ অর্থনৈতিকভাবে এবং প্রযুক্তিগতভাবে চরম উন্নত। এই যে একটি বিশ্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার যে কল কাঠি এর পিছনেও ওইসব বিশ্ব মোড়লদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আজকে যদি আমরা আমেরিকা এবং ইউরোপের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো তাদের অর্থ ব্যবস্থার মধ্যে অস্ত্র নির্মাণ এবং তার বিক্রি একটি বিশেষ অংশ দখল করে আছে। দেশে দেশে অঞ্চলে অঞ্চলে সংঘাত সৃষ্টি করে এইসব দেশ সংঘাত সঙ্কুল ওইসব দেশে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বিক্রি করে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে তারা আমেরিকা এবং ইউরোপের কাছ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র খরিদ করে। বর্তমানের এইযে বিশ্বব্যবস্থা এর পিছনের মূল চালিকা শক্তি হল ডলার, আমেরিকান ডলার। এই ডলারের বিপরীতে যারা দাঁড়িয়েছে তাদেরকেই আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তি ধ্বংস করে দিয়েছে যেমন ইরাক এবং লিবিয়া। আজকে ডলার যাকে বলা হয়, পেট্রোডলার এটা কিভাবে হলো? প্রেসিডেন্ট রিচার্ড মিলহাওস নিক্সন ১৯৬৯ সালে থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত আমেরিকার ৩৭ তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ঐ সময় সৌদি আরবের সাথে আমেরিকা গোপন চুক্তিতে পৌঁছায় যে তেল বিক্রয় ডলারে হবে।
The emergence of the petrodollar dates back to the early 1970s when the U.S. reached an agreement with Saudi Arabia to standardize the sale of oil based on the U.S. dollar. Petrodollar recycling creates demand for U.S. assets when dollars received for oil sales are used to buy investments in the United States.
আজকে আমেরিকার অর্থনীতি এবং বিশ্বশক্তি হওয়ার প্রাণ ভোমরা হলো এই পেট্রোডলার। আমেরিকা পেট্রোডলার ছাপায় এবং সারাবিশ্ব তা ব্যবহার করে। আমি অর্থনীতিবীদ নই তাই এ সম্বন্ধে আর বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু এইটুকু বুঝতে পারি সারা বিশ্বের ডলারের চাহিদা যদি একটি দেশ সরবরাহ করে সেদেশের অর্থনীতি যে বিশ্বে এক নম্বর অবস্থানে থাকবে এটাই সত্য এবং স্বাভাবিক যা আমেরিকা আজকে।
আমেরিকা নিজেকে বিশ্বশক্তি হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য যেমন ডলার ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে তেমনি সৃষ্টি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো।
ইউক্রেনকে অন্তর্ভুক্ত করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সীমানা বৃদ্ধি করতে গিয়ে আজকে ইউক্রেন রাশিয়ার আক্রমণের শিকার হয়েছে। এটাকি অবশ্যম্ভাবী ছিল? আমি বলব এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। কারণ এর পিছনে যে শক্তি তা হল পেট্রোডলার ভিত্তিক এক নম্বর বিশ্বশক্তি আমেরিকা। আমরা দেখেছি ইরাক এবং লিবিয়া পেট্রোডলার কে মোকাবেলা করতে গিয়ে আমেরিকা ও কোয়ালিশন ফোর্সের আক্রমণের শিকার হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে রাশিয়ার আবির্ভাব এবং বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার আকাঙ্ক্ষা এবং চীনের বিশ্বশক্তি হিসেবে সামরিক এবং অর্থনৈতিক উত্থান আজকে পেট্রোডলার কে হুমকির মুখে ফেলেছে। এই হুমকি যে যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের কোথাও না কোথাও আবির্ভূত হবে এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। আমেরিকা ও ন্যাটোর পক্ষে ইরাক ও লিবিয়াকে কে ধ্বংস করা সম্ভব হলেও আজকের চীন এবং রাশিয়াকে আমেরিকার পক্ষে সামরিকভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাই আমেরিকা ও ন্যাটো রাশিয়াকে পরোক্ষভাবে মোকাবেলা করতে গিয়ে ইউক্রেনকে বলির পাঁঠা বানিয়েছে। এইযে প্রক্সিওয়ার এটা নতুন কিছু নয়। সৌদি আরবকে দিয়ে আমেরিকা ইয়েমেনে তা পরিচালিত করছে। সিরিয়াতেও আমরা একদিকে রাশিয়া এবং অন্যদিকে আমেরিকাকে ইনভল্ভ দেখতে পাই।
আজকে যদি আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব পশ্চিমা বিশ্ব ব্যবস্থা আজকে হুমকিতে পড়েছে চীন এবং রাশিয়ার দ্বারা। আমেরিকা চীন কে মোকাবেলা করার জন্য অতিসম্প্রতি কোয়াড গঠন করেছে যার সদস্য দেশ হলো আমেরিকা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান।
The Quadrilateral Security Dialogue (QSD), colloquially the Quad or QUAD, is a strategic security dialogue between the United States, India, Japan and Australia that is maintained by talks between member countries.
উদ্দেশ্য হল দক্ষিণ চীন সাগরে চীনকে মোকাবেলা করা।
যখন বিশ্বব্যবস্থা এবং বিশ্বশক্তি ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে তখন চারিদিকে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। যুদ্ধ যে সবসময় ধ্বংসযজ্ঞ বয়ে এনেছে এটা ঠিক তবে এই যুদ্ধের দ্বারা অনেক মহান এবং ভালো ব্যবস্থাও বিশ্বকে ঢেলে সাজিয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধের ফলে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯২০ সালে লীগ অফ নেশনস গঠিত হয়। এই লীগ অফ নেশনস যখন তার কার্যকারিতা হারায় তারপরে ১৯৩৯ সাল হতে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হলে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইউনাইটেড নেশনস গঠিত হয়। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফ। ১৯৪৫ সাল হতে ১৯৬০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ৩ ডজন দেশ স্বাধীনতা লাভ করে কলোনিয়াল মাস্টারদের কাছ থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মোটাদাগে কলোনিয়ালিজমের পরিসমাপ্তি ঘটে।
বর্তমানে ইউক্রেনে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে এর মধ্য দিয়ে হয়তো একসময় পেট্রোডলার এবং আমেরিকান বিশ্বব্যবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটবে। নতুন ব্যবস্থায় বিশ্বের আরো বিকশিত হবার আরো ইতিবাচক হবার সুযোগ সৃষ্টি হবে তেমন আশা আমরা করতে পারি। কারণ দুইটি বিশ্বযুদ্ধের পরে তেমন ইতিবাচক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে আমরা দেখেছি।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সেনা-কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।