অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, (অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ ও কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) :
১৯৪৮ সাল থেকে ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণভূত্থান, ১৯৭০ সালে আওয়ামীলীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি রচনায় বিরাট অবদান রাখে। তবে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তার মাধ্যমে বাঙালি যে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় চূড়ান্ত আন্দোলন সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং স্বাধীনতার জন্য কি কি করতে হবে তার প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা জনতার সামনে প্রকাশ পায়। আরো স্পষ্ট করে বললে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য সাধারণ বহুমাত্রিক বিশেষত্বে পূর্ণ ১৮ মিনিটের এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন এবং স্বাধীনতা অর্জন করতে যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা দেন। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে"। পাকিস্তানিদের সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে এবং পাকিস্তানি সেনারা তাঁর দিকে বন্দুকের নল তাক করে আছে জেনেও বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত কৌশলে সমগ্র বাঙালি জাতির আবেগে কথাটি প্রকাশ করে ফেলেন। বঙ্গবন্ধু বলেই ফেললেন “তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” বঙ্গবন্ধুর এই কথার পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার আর কিছুই বাকি রইলো না। তাই ৭ মার্চের গুরুত্বকে যারা পরিপূর্ণরূপে স্বীকার করে না তাদেরকে বাংলাদেশের নাগরিক বলা যায় না। বঙ্গবন্ধুর এই অমর ভাষণ ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। নিউজউইক ম্যাগাজিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কারণ এই ভাষণ শুধু সেরা ভাষণ নয়, বিশ্বের সেরা ভাষণের একটি। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রামের এক অনন্য দলিল। ২০১৭ সালের অক্টোবরের শেষে ইউনেস্কো ৭মার্চের ভাষণকে ”ডকুমেন্টরী হেরিটেজ” (বিশ্ব প্রামান্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং মেমোরি অফ দ্য ওর্য়াল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে (এম ও ডব্লিউ) ৭ মার্চের ভাষণসহ এখন পর্যন্ত ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগৃহীত হয়েছে।
এরপরেও অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, স্বাধীন দেশে দীর্ঘসময় এই ভাষণের প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করার পরে এবং ১৯৯৬ সালে জনতার ভোটে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর এই ভাষণের বিষয়ে ও সঠিক ইতিহাসের বিষয়ে তৎকালীন প্রজন্ম তেমন কিছুই জানতে পারে নি। বরং ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দেশে সঠিক ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে তৎকালীন প্রজন্ম অজ্ঞই থেকে গেছে।
জাতির চরম ক্রান্তিকালে স্বাধীনতাকামী ৭ কোটি মানুষের প্রতি এ ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু যে যুক্তিপূর্ণ অথচ আবেগময়, সংরক্ষিত অথচ সুদূর প্রসারী ইঙ্গিতপূর্ণ অথচ অর্থবহ বাক্য ব্যবহার করেন তা বাংলাদেশের মানুষকে তা আজও একাত্তরের মতো সমভাবে উদ্দীপ্ত ও জাগ্রত করে তোলে। এ ভাষণের মধ্যদিয়ে বাঙ্গালী জাতি বিশ্ব ইতিহাসে মর্যাদার আসন লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ভাষণের কারণেই ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ এর বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরিশেষে বলবো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আবেদন চিরন্তন। এই ভাষণে মানুষ আজো আন্দোলিত ও শিহরিত হয়। সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষকে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। তরুণ প্রজন্মের মাঝে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ছড়িয়ে দিতে হবে। বর্তমানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে আমাদের সবাইকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে।
লেখক:
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ ও কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।