অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান :
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ও ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা মূলত একই সূত্রে গাঁথা। যদিও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতা আন্দোলনে বিরাট ভূমিকা রাখেন এবং অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য সাধারণ বহুমাত্রিক বিশেষত্বে পূর্ণ ১৮ মিনিটের এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন এবং স্বাধীনতা অর্জন করতে যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা দেন। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে"। পাকিস্তানিদের সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে এবং পাকিস্তানি সেনারা তাঁর দিকে বন্দুকের নল তাক করে আছে জেনেও বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত কৌশলে সমগ্র বাঙালি জাতির আবেগের কথাটি প্রকাশ করে ফেলেন। বঙ্গবন্ধু বলেই ফেললেন “তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
বঙ্গবন্ধুর এই কথার পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার আর কিছুই বাকি রইলো না। তারপরেও বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশকে স্বাধীন করার যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা পরিপূর্ণতা পায় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। যে কারণে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এবং ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা মূলত একই সূত্রে গাঁথা।
আমাদের সকলেরই জানা উচিত ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়েছিল। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পূর্বেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে এদেশের মানুষের উদ্দেশ্যে একটি তারবার্তা পাঠান। ইপিআরের ওয়ারলেস বার্তায় স্বাধীনতার সেই ঘোষণা প্রচারও করা হয়।
১৯৮২ সালে তথ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র তৃতীয় খন্ডে বলা হয়েছে, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এ ঘোষণা (বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা) দেন তিনি (বঙ্গবন্ধু), যা তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে বেশ কয়েকজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে পাকিস্তানের তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় সামরিকবাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে লিখেছেন যখন প্রথম গুলিটি ছোড়া হল, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে ক্ষীণস্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হল আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
তিনি আরো লিখেছেন, ঘোষণা বলা হয়, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’
এখানে আরো একটি বিষয় বলে রাখা ভালো যে, ২৫ মার্চ রাত থেকে শুরু করে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর পর্যন্ত দ্রুত অবনতশীল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে একাধিক রেডিওতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বেতারের ঢাকা কেন্দ্র পাকিস্তানিদের দখলে চলে গেলেও বঙ্গবন্ধু গোপন তিনটি রেডিও ট্রান্সমিটার তিন জায়গায় প্রস্তুত রেখেছিলেন। পিলখানার এক সুবেদারের কাছে তাঁর একটি পূর্ব রেকর্ডকৃত ভাষণ ছিল। যেটির কোড ছিল ‘বলদা গার্ডেন’। ক্র্যাক ডাউনের খবর জেনে সেটি প্রচারের লক্ষ্যে ওই সুবেদারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। পরে দ্বিতীয় ট্রান্সমিটারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। সেখানে টেলিফোনের মাধ্যমে নতুন করে স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করান বঙ্গবন্ধু এবং একটু পরেই তা প্রচার করা হয়। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের তিন জন সাংবাদিকের কাছে এ তথ্য জানিয়েছিলেন।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হ্যান্ডবিল আকারে বাংলা ও ইংরেজিতে ছাপিয়ে চট্টগ্রামে বিলি করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামের ইপিআর সদর দপ্তর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়্যারলেস মারফত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান ওই দিন দুপুর ২টা ১০ মিনিটে এবং ২টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। তাই এই কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান ঘোষক এবং তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র স্থপতি। অন্যরা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধনীতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন মাত্র কিন্তু তারা কোনোভাবেই স্বাধীনতার ঘোষক হতে পারেন না।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ স্বাধীনতার যে ডাক দিয়েছিলেন তারপর থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলা ক্রমশ উত্তাল হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণার পরে ২৫শে মার্চ রাতে শুরু করা গণহত্যা ২৬ মার্চেও চালিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট, ভারী মর্টার, হালকা মেশিনগানসহ বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করে নিরস্ত্র বাঙালি জনতার উপর নির্মম নিষ্ঠুর নারকীয় হত্যাকান্ড চালায় পাকিস্তানি সেনারা। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাংলার চলমান আন্দোলনকে দেশদ্রোহিতা আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগকে ‘নিষিদ্ধ’ করেন। পরের ইতিহাস আপনাদের সবারই জানা। চলে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের ৩০ লক্ষ মানুষ স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেন। দু’ লক্ষ মা বোন ইজ্জত হারান। অবশেষে অর্জিত হয় বাংলাদেশের বহুল কাঙ্খিত বিজয়।
পরিশেষে বলবো দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। যা ছিল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচীর বিস্তারিত ব্যাখ্যা। ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু
বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর নির্দেশনা দেন। ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায় যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানানোর সাথে সাথে কলকারখানায়, ক্ষেতখামারে উৎপাদন বৃদ্ধির নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বাংলার মানুষ যাতে ভালো থাকেন তিনি সেই নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। আজকের দিনে আমাদের শপথ হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবো এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা উন্নত বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করবো। ইনশাআল্লাহ।
লেখক: অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ ও কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।