ডা, জয়নাল আবেদীন :
আমার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমার ঝুলে থাকার রায় হয়েছে। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমার দণ্ড কার্যকর করা হবে।
আমার এই বিচার কাজে বিচারক ছিলাম আমি, আমার বিরুদ্ধে সাক্ষীও হয়েছি আমি নিজেই। দন্ড কার্যকর করার দায়িত্বও আমার উপর। আমার মৃত্যুকে আমি আত্মহত্যা বলতে রাজি না। আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। টানা দুই দিন চিন্তা করে আমি আমার নিজের বাঁচার কোন কারণ খুঁজে বের করতে পারিনি।
কেউ যদি একটা কাজের জন্য যোগ্য না হয় তবে সেখানে রিজাইন দেয়াটাই নিয়ম। অনেক হিসেব করে দেখলাম আমি পৃথিবীর জন্য যোগ্য না। এ জন্য আজ নিজে নিজেই আদালত বসিয়ে রায় শুনিয়ে দিলাম। আমি পৃথিবী থেকে রিজাইন করছি। এতে খারাপের কিছু নেই। রিজাইন না করলেও এক সময় রিটায়ার্ড করতে হয়। দুইটাই একই ব্যাপার।
আমার স্ত্রী নীলা সব কিছুতে যুক্তি খুঁজতে ভালোবাসে। তার কথা মতে যুক্তি বলছে এখনই রিজাইন করার সময়।
এখন আমি কেবল দণ্ড কার্যকর করার অপেক্ষা করছি।
একটা লেখাতে পড়েছি ফাঁসির মৃত্যুতেই নাকি কষ্ট সব চেয়ে বেশি হয়। এ সব রিসার্চকে আমার কাছে গাজাখোরী জিনিস ছাড়া কিছু মনে হয় না। কেউ কি দশ ভাবে মরার পর এসে বলেছে, ভাইরে... বিশ্বাস কর সব ভাবে ট্রাই মেরে দেখলাম ফাঁসিতেই কষ্ট বেশি। তোরা যেমনেই মর, ফাঁসিতে ঝুলিস না।
যত সব ফালতু রিসার্চ।
আমার চাকরি চলে গিয়েছে। চাকরির সাথে সাথে স্ত্রীও হাওয়া।
সাত বছর প্রেম করার পর তিন বছর এক সাথে সংসার করা স্ত্রীর সম্পর্ক আমার চেয়ে বোধহয় আমার চাকরির সাথেই বেশি ছিল। এই ঘটনাকে কি বলে যায় 'চাকরির হাত ধরে স্ত্রীর পলায়ন' নাকি ' স্ত্রীর হাত ধরে চাকরির পলায়ন?'
আমার হাতে সময় বেশি নেই। মনে মনে রসিকতা করার সময় এখন না। কেবল আমার স্ত্রী চলে গেলেও সমস্যা হত না, বাড়ি থেকে বাবা আমাকে ত্যাজ্য করেছেন।
কোন কিছুই কারণ ছাড়া হয়না। আমাকে ত্যাজ্য করার যথেষ্ট কারণ আছে। আমি বাবার কাছে থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা চুরি করে পালিয়েছিলাম। বাবার কাছে থেকে কৌশলে টাকা হাত করি। আমার উদ্দেশ্য মোটেই খারাপ ছিল না, পার্টনার খারাপ ছিল। ব্যবসা ঠিক মতো চললে দুই বছরেই বাবার টাকা ফেরত দিতে পারতাম। পার্টনার টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। বাবা তাঁর সারা জীবনে সঞ্চয় করা টাকা হারিয়ে মাইল্ড স্ট্রোক করে ফেললেন। তারপর হাসপাতাল থেকে ফিরে প্রথম কাজ হিসেবে আমাকে ত্যাজ্য করেছেন।
এক সপ্তাহ আগে আমার চাকরি চলে গেছে। অফিসের এমডির বিরুদ্ধে মুভমেন্ট হচ্ছে। সবাই মিলে আমাকে লিডার বানিয়ে দিল। আমি গরম গরম বক্তব্য দিলাম, সবাই তুমুল হাত তালি দিল। মুভমেন্ট যে মুখে হয় না, মাথায় হয় এটা যখন বুঝলাম তখন আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে। এমডি মুহূর্তের মধ্যে সব ঝামেলা মিটিয়ে ফেললেন। লিড দেয়ার অপরাধে আমাকে বরখাস্ত করা হল। যে লোক আমাকে সব চেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছিল সেই তিন ধাপ প্রমোশন পেয়ে পরের দিন হাসি মুখে আমার চেয়ারে গিয়ে বসল।
কান পর্যন্ত হাসি দিয়ে বলল, শুভ সাহেব, মন খারাপ কইরেন না ভাই। রিজিকের মালিক আল্লাহ পাক। আপনি এর চেয়ে ভালো চাকরি ডিজার্ভ করেন। রাতে আমার বাসায় দাওয়াত রইল। ভাবীরে নিয়া আইনেস কিন্তু। আমার বউ নতুন এক রান্না আবিষ্কার করেছে। কচুর লতি ভর্তার সাথে মুরগী ফ্রাই। একেবারে অমৃত।
আমার স্ত্রীকেও দোষ দেয়া যায়না। এই মুহূর্তে আমি সাড়ে সাত লাখ টাকা দেনার উপর আছি। সামনের মাসে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। চাকরি নেই, কোথায়ও যাওয়ায় কোন উপায় নেই।
আমাকে গত পরশু ডেকে নীলা বলল, শুভ তোমার তো সব শেষ। এখন কি করবে?
আমি বললাম, আত্মহত্যা করব।
নীলা সহজ গলায় বলল, তোমার মরে যাওয়াই উচিত। তবে সেটাকে আত্মহত্যা না বলে বলো রিজাইন, জীবন থেকে নিজেকে স্বেচ্ছায় অপসারন।
- হু জীবন থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়াব।
- তুমি তো মরে যাচ্ছ, আমার কি করা উচিত বলতো? তোমার সাথে সহমরণ?
- না।
- তোমার সামনে কোন রাস্তা খোলা নেই। মানুষ হিসেবে তুমি চূড়ান্ত বোকা, জীবনে টাকার পেছনে গিয়ে বার বার ধরা খেয়েছো। আমাকে কখনো সময় দেয়ার কথা চিন্তা করনি। আমার কোন পরামর্শ নেয়ার কোন দরকার মনে করনি। আমি কি ঠিক বলছি?
- হাঁ।
- এখন আমার করনীয় কি?
- আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও।
নীলা বলল, দুঃখিত। তোমাকে ডিভোর্স দেয়ার আমার কোন ইচ্ছে নেই। আমি তোমার সাথে আজকেই শেষ বারের মতো আছি। কালকে থেকেই আমি অন্য কোথাও চলে যাচ্ছি। আমার বাবার বাড়িতে গিয়ে লাভ হবে না। আমি সেখানে থাকব না। আমার নাম্বারও বন্ধ থাকবে। আমি একটা খবর শুনতে চাই, তুমি সফল ভাবে জীবনে একটা হলেও কাজ করেছো... মরে গিয়ে।
তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?
আমি বললাম, না।
নীলার এত কঠিন কথা আমাকে কেন জানি স্পর্শ করল না।
:
:
আমি নীলার একটা ওড়না ফ্যানের সাথে আটকিয়ে দিলাম। টান দিয়ে পরীক্ষা করে মনে হল আমার ভর নেয়ার জন্য যথেষ্ট হয়েছে। ওড়নার সাথে ঝুলে পড়া মাত্র কয়েকটা ঘটনা ঘটবে। আমার ক্যারোটিড আর্টারি ছিঁড়ে যাবে। তারপর মস্তিস্ক এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবে। আমার কাঁধের দিকের একটা হাড়ের অংশ বিশেষ ভাঙবে। এর ফলে মাথার সাথে নার্ভ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তার কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি হাত উপরে তুলতে পারব না। বাঁচার জন্য হাঁসফাঁস করতে করতে আমি মারা যাব।
আশ্চর্য ব্যাপার আমার কোন ভয় লাগছে না। ফাঁসি দেয়া মানুষ কিভাবে মারা যায় সেটা আমি গত কালকে পড়েছি। আমার মৃত্যু প্রক্রিয়া আমার জানার দরকার আছে। ভাঙতে যাওয়া ঐ হাড়ের নাম মনে করতে পারছি না বলে কিছুটা খারাপ লাগছে।
আমি ফ্যানের নিচে থেকে সরে এলাম। মরার আগে আমার খুব দরকারি কাজ বাকি আছে। একটা সুইসাইড নোট লিখতে হবে। নীলা বার বার বলে দিয়েছে মরে যাওয়ার আগে যাতে এই কাজটা করতে ভুল না করি। ফাঁসিতে ঝুলার ঠিক আগেই এই কাজ করতে হবে। স্পষ্ট করে লিখতে হবে " আমি আমার জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে মরতে যাচ্ছি। আমার মরার জন্য কেউ দায়ী না।"
নোট না লিখলে নীলা ঝামেলায় পড়বে। জীবিত অবস্থায় তাকে কম যন্ত্রণা দিই নি, মরার পর যন্ত্রণা দেয়ার কোন মানে নেই।
আমার মৃত্যু আত্মহত্যা না, নীলা বলে দিয়েছে। যেহেতু আমার মৃত্যু বিচারের মাধ্যমে হয়েছে তাই আমার শেষ ইচ্ছা বলে একটা জিনিস আছে।
আমি আমার ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, জনাব শুভ, আপনার শেষ ইচ্ছে কি?
আমি নিজেই জবাব দিলাম, আমি একটা সিগারেট খেতে চাই। দশ মিনিট সময় লাগবে।
- মঞ্জুর।
আমি একটা সিগারেট ধরালাম। মা মারা গেছেন ১১ বছর হয়। মায়ের মুখ চোখের সামনে থেকে চলে গেছে। বাবার সাথেও কথা হয়না অনেক দিন। মরার আগে কি তাদের কথা চিন্তা করা উচিত?
আমি তাদের চিন্তা বাদ দিলাম। মৃত্যুর আগে আবেগ নিয়ে আসতে চাই না।
হিসেব মতে আমি জাহান্নামে যাবো। অবশ্য স্বাভাবিক ভাবে মরলেও জান্নাতে যাওয়ার সুযোগ আমার খুব ই কম। কোন দিন বড় কোন ভালো কাজ করিনি। ধর্ম কর্ম কখনোই ভালো মতো পালন করতে পারিনি। আমি ধর্মের চিন্তাও মাথা থেকে বের করে ফেললাম।
আমি সৃষ্টিকর্তার জন্য কোন দিন কিছু করিনি, সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি কি চাইতে পারি?
যুক্তি সেটা বলে না। জীবন যুক্তিতে চলবে, এটা নীলার কথা।
শেষ সময়ে কি আমি কোন গান শুনতে পারি? গান শোনতে শোনতে আমার মৃত্যু হবে, অসাধারণ একটা ব্যাপার।
কোন বিরহ ধর্মী গান শোনা যেতে পারে।
যেমন 'যখন আমি থাকব না কো, আমায় রেখো মনে' কিংবা 'চলে যায় যদি কেউ বাঁধন ছিঁড়ে কাদিস কেন মন"।
বাংলা গানের জগত এই একটা দিক থেকে অনন্য, বিরহের গানের কোন অভাব নেই।
গান শোনার ছেলে মানুষী চিন্তা আমি বাতিল করলাম।
দশ মিনিট শেষ হয়ে গেল। আমার হাতে এখন একটা মাত্র কাজ বাকি। সুইসাইড নোট লিখতে হবে...সরি রিজাইন লেটার। জীবন থেকে পদত্যাগ পত্র।
আমি ড্রয়ার থেকে ডায়েরি বের করলাম। মাঝখানের একটা পাতা বের করেই চমকে উঠলাম।
নীলার হাতের লেখা- " বাহ সাহস তো কম না, সুইসাইড করতেই যাচ্ছ? নোট একটু পরে লিখবে, যাও ড্রেসিং টেবিলের আয়নার পেছনে গিয়ে দেখো...
আমার মাথা কাজ করছে না। নীলার লেখা আমার ডায়েরিতে কেন? আমি মনমুগ্ধের মতো করে আয়নার পেছনে হাত দিলাম। একটা ফুলের তোড়া বেরিয়ে এল। ফুল কিছুটা চুপসে যাওয়া অবস্থা। ফুল সম্ভবত দুই তিন দিন আগের। এখান থেকে একটা কাগজ বের হল। কাগজে একটা ফোন নাম্বার।
নীলা লিখেছে, বে আক্কেল পরে মরবা। আগে এই নাম্বারে কল করো।
আমি ফোন হাতে নিয়ে কল করলাম।
রিসিভ করা মাত্র কিছুই বলতে পারলাম না। আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগল।
:
:
রাত সাড়ে এগারোটা। আমি আর নীলা একটা ফুচকা ভ্যানের পেছনে বসে ফুচকা খাচ্ছি।
আমার দণ্ড কার্যকর করতে পারিনি। নীলাকে ফোন করা মাত্র এখানে আসতে বলেছে। আমি কিভাবে চলে এসেছি নিজেই জানিনা।
নীলা আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, তার মানে সত্যি সত্যি মৃত্যু চেষ্টা করা হয়েছে?
-হু।
- আচ্ছা বেকুব তো, আমি জীবনে যত গুলো ভালো কাজের পরামর্শ দিয়েছি একটাও শুনোনি, শেষ পর্যন্ত মরার বুদ্ধিটাই শুনলে?
আমি বললাম, নীলা আমার যাওয়ার কোন রাস্তা নেই, এই একটাই রাস্তা। এই রাস্তাতেই তো আমার যাওয়া উচিত, যুক্তি তাই বলে।
নীলা বলল, না যুক্তি তাই বলেনা। রিজাইন করা আর পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। তুমি জীবন থেকে পালিয়ে যাচ্ছ। রিজাইন করাকে সমর্থন করা যায়, পালিয়ে যাওয়াকে না।
কাপুরুষরা সমস্যা থেকে পালিয়ে যায়। প্রকৃত মানুষ সমস্যার মধ্যে গিয়ে সমাধান খুঁজে বের করে। জীবনে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে যাত্রা শেষ না, সাময়িক সময়ের জন্য কেবল যাত্রা বিরতি। জীবনে যখন একটা রাস্তা বন্ধ হয় ঠিক তখনই আরেকটা রাস্তা খুলে যায়। তখন কেবল অপেক্ষা করতে হয় নতুন রাস্তা খুঁজে পাওয়ার।
আমি বললাম, কিন্তু তুমিই তো বলেছিলে কেউ যদি কোন কাজের যোগ্য না হয় তবে সেখান থেকে সরে যাওয়া উচিত।
নীলা বলল, আমি বলেছিলাম, ইচ্ছে করেই ভুল বলেছি। চাকরি আর জীবন এক না। চাকরীতে নিজের ইচ্ছেয় জয়েন করা যায়, নিজের ইচ্ছেয় রিজাইন ও আছে। জীবনে নিজের ইচ্ছেয় জয়েন বলে কিছু নাই। তুমি যার ইচ্ছেয় এসেছো তার ইচ্ছেতেই তোমাকে যেতে হবে। যুক্তি তাই বলে।
- হু।
- তারপর চিন্তা করো। তুমি কার জন্য মরতে গিয়েছিলে?
চাকরির জন্য, টাকার জন্য আর আমার জন্য..এই তো?
তুমি কি মনে করো তুমি মরে গেলে তোমার অফিস তোমার শোকে বন্ধ হয়ে যেত? তুমি মরে গেলে আমি কাঁদতাম, বিশ্বাস করো। কিন্তু সেটা কত দিন?
এক মাস, এক বছর। তারপরই আমার পথ আমি খুঁজে নিতাম। দুই বছর এখানে অন্য কারো হাত ধরে বসে ফুচকা খেতাম। যুক্তি কি তাই বলে?
- হাঁ।
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, কিন্তু নীলা আমি তোমার লেখাটা যদি কাঁকতলিয় ভাবে না পেতাম তবে এতক্ষণে মারাই যেতাম। কি আশ্চর্য যে ডায়েরির যে পাতাটা বের করলাম ঠিক সে পাতাতেই তোমার লেখা। এই পাতা মিস করলে এতক্ষণে আমি ঝুলে থাকতাম। কাল চলে যেতাম পোস্টমর্টেমে।
নীলা হাসতে হাসতে বলল, মিস হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তোমার ঘরে দুইটা ডায়েরি ছাড়া আর কোন কাগজ নেই। এই দুই ডায়েরির প্রতিটা পাতায় আমি এই একই কথা লিখে রেখেছি।
আমি অবাক হয়ে নীলার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
নীলা বলল, সুইসাইড করা প্রায় প্রতিটা মানুষ নোট লিখে। আমার পুরো বিশ্বাস ছিল তুমি নোট লিখতে গেলেই আমার লেখা পড়বেই। আর মস্তিস্কের ঐ বিশেষ অবস্থায় সুইসাইড কারী প্রতিটা মানুষ অবচেতন ভাবে হলেও বাঁচার ভরসা খুঁজে। এ রকম একটা ভরসা পেলে কেউই মিস করবে না। যুক্তি তাই বলে।
আমি বললাম, কিন্তু তারপরও একটু বেশি রিস্ক হয়ে গেল না? আমি যদি নোট না লিখতাম, কিংবা নোট লেখার জন্য অন্য কোন কাগজ খুঁজতাম?
নীলা মিষ্টি করে হেসে বলল, তোমাকে লাইনে আনার জন্য কিছুটা রিস্ক নিতেই হল।
:
:
এই মুহূর্তে আমার মাথায় একটা গোল টুপি। নীলা এই মাত্র আমাকে কিনে দিয়েছে।
নীলার কথা মতে আমি প্রচণ্ড হতাশ একজন মানুষ, আমার লাইনে আসার প্রথম কাজ হচ্ছে ধর্ম কর্ম করা। এ ছাড়া আমার জীবনে শান্তি আসার সম্ভবনা নেই।
নীলার পরিকল্পনা মতে আমরা আগামী সপ্তাহে গ্রামে গিয়ে বাবার পায়ের উপর উপুড় হয়ে পড়ব। নীলা বলেছে সে যে ভাবেই হোক বাবাকে মেনেজ করবে। কাজটা অনেক কঠিন কিন্তু তারপরও তাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। যে এত কিছু করে ফেলেছে তাকে বিশ্বাস না করে উপায় নেই।
আমার হাতে কোন টাকা পয়সা নেই, সাড়ে সাত লাখ টাকা ঋণ। নীলা বলেছে এই ব্যাপারে চিন্তা না করার জন্য। আমরা রাতের বেলা ফুটপাত ধরে হাঁটছি। কেন জানি সব কিছুকেই অসম্ভব সুন্দর মনে হচ্ছে।
নীলা বলল, তুমি কোন দিন জীবন কে ভালবাসোনি। একবার মৃত্যুর কাছে থেকে ফিরে এসেছো। এখন কি আশা করতে পারি যে জীবনকে নতুন করে ভালোবাসবে? টাকার পেছনে দৌড়ানো বাদ দেবে?
আমি বললাম, অবশ্যই আশা করতে পারো।
নীলা বলল, তোমার জীবন নিয়ে এত বড় রিস্ক নেয়ার জন্য আমি দুঃখিত। তবে তোমার জন্য বড় কোন রিস্ক না নিয়েও কিছু করার ছিল না।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, অবশ্যই, যুক্তি তাই বলে।
নীলা বলল, কোন যুক্তি ছাড়াই আমি তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি। তুমি সেটা জানো না।
একটা ট্রাক আমাদের পেছনে এসে বিকট স্বরে হর্ন দিল।
আমি বললাম, দেখেছো নীলা আজকে ট্রাকের হাইড্রলিক হর্নকেও কত মধুর মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে ররি শংকর বাবুর বাঁশির
মতো মিষ্টি সুর।
নীল মুখ লাল করে বলল, রবি শংকর বাঁশি বাজাতেন না বেকুব, সেতার বাজাতেন। না জেনে মিথ্যা বলার আর জায়গা পাও নি?
আমি বললাম, নীলা, একটা জিনিস খেয়াল করেছো? জগতের খারাপ মানুষদের প্রতি সৃষ্টিকর্তা একেবারে নির্দয় হন না। কিছু একটা চমৎকার জিনিস দান করেন।
নীলা বলল, তারপর..
আমি মুখ কাচুমাচু করে বললাম, আমার মতো মানুষের জীবনে তোমার মতো কাউকে পাওয়া কত বড় দান ভাবতে পারো?
নীলা হাসল, আমিও হাসলাম।
আমাদের জীবনের এই চরম সুখের সময়ে কোন সাক্ষী নেই।
আফসোস।
#সুইসাইড_নোট
জয়নাল আবেদীন
০১. ১২. ২০১৫