মুহাঃ জিল্লুর রহমান, সাতক্ষীরা সংবাদদাতা:
ডেনমার্কের রাজকুমারী ম্যারি এলিজাবেথ ডোনাল্ডসন শ্যামনগরের উপকূলবর্তী এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সমবেত প্রচেষ্টায় সব প্রতিকুলতাকে অতিক্রম করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সাতক্ষীরায় একদিনের সফরকালে বুধবার বেলা ১১টার দিকে শ্যামনগর উপজেলার উপকূলবর্তী এলাকা পরির্দশনকালে পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতির শিকার মুন্সিগঞ্জের কুলতলি গ্রামের নারীদের সাথে আলাপচারিতায় তিনি এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। লবণাক্ততা বৃদ্ধিতে ফসল উৎপাদন হ্রাস পেলেও খাল খননের মাধ্যমে মিষ্টি পানি সংরক্ষণপুর্বক সবজীসহ কৃষি ফসল চাষ করে ঐ অংশের উপকূলীয় নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার ঘটনাকে তিনি অনুকরণীয় হিসেবে উল্লেখ করেন।
এসময় ডেনিস রাজকুমারী সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলবর্তী এ গ্রাম ঘুরে সিএনআরএস (সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্ট্যাডিস) এর বাস্তবায়নাধীন গভর্নেন্স ফর কোস্টাল রেজিলিয়েন্স প্রজেক্টের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হন।
এসময় তার সাথে ছিলেন ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত উইনি এসট্রাপ পিটারসেন, ডেপুটি রাষ্ট্রদূত লেনি ভলকারসেনসহ ডেনমার্কের এক মন্ত্রী ও দূতাবাস কর্মকর্তারা।
কুলতলি গ্রাম পরিদর্শনকালে রাজকুমারী কুলতুলি খাল ঘুরে দেখেন এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরুপ প্রভাবের শিকার পুষ্প রানী মন্ডল, শিলা রানী, টুম্পা মন্ডল, আরতী বালা ও হেমলতা মন্ডলের সাথে কথা বলেন। এসময় ম্যারি এলিজাবেথ ডোনাল্ডসন উপকূলীয় জনপদের এসব নারীদের চরম প্রতিকূলতার সত্তে¡ও পুনরায় ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প শুনে রীতিমত বিস্মিত হন। সিএনআরএস এর সহযোগিতায় অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে সরকারি খাল উদ্ধারসহ তা পুনঃখনন এবং দিনে দিনে লবণাক্ততা বৃদ্ধি সত্ত্বেও মিষ্টি পানির উৎস ব্যবহার করে এক ফসলী জমিতে সারা বছর সবজী চাষের মাধ্যমে পরিবারগুলোর স্বাবলম্বী হওয়ার ঘটনায় প্রশংসা করেন। এসময় রাজকুমারী স্থানীয় নানা বয়সী গ্রামবাসীর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন এবং তাদের সাথে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করার পাশাপাশি ছবি উঠান।
পরবর্তীতে রাজকুমারী দুর্যোগকালীন সময়ে স্থানীয়দের আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত কুলতলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার পরিদর্শন করেন। এসময় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সরোজ কুমার মন্ডল ফুল দিয়ে অতিথিকে বরণ করে ননে। পরে মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন সিপিপি টিম লিডার জগদীশ মন্ডলের সাথে রাজকুমারী কথা বলেন। তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে উপকূলবাসীকে সতর্ক করাসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে বৃদ্ধ, শিশুসহ গর্ভবতী ও প্রসূতি নারীদের নিরাপদে নিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত নানা বিষয়ে সিপিপি টিম লিডারের কাছে জানতে চান। একইভাবে সাইক্লোন শেল্টারের ধারণ ক্ষমতাসহ আশ্রয়গ্রহণকারীদের জন্য সুপেয় খাবার পানির ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত হওয়ার চেষ্টা করেন রাজকুমারী। প্রায় ১৫ মিনিট অবস্থানের পর ম্যারি এলিজাবেথ ডোনাল্ডসন বুড়িগোয়ালীনির ভাঙ্গন কবলিত দাতিনাখালী এলাকার উপকূল রক্ষা বাঁধ পরিদর্শন করেন এবং ভাঙ্গনের শিকার কয়েকটি পরিবারের সাথে কথা বলেন।
বেলা দুইটার দিকে মুন্সিগঞ্জের কলবাড়ী এলাকায় বরসা রিসোর্ট সেন্টারে পৌছে মধ্যহ্নভোজ গ্রহণের পর বেলা তিনটার দিকে তিনি মাল নদী দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেন। এসময় প্রায় ৩০ মিনিট ধরে তিনি বিশ্বখ্যাত সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবনের কলাগাছিয়া এলাকার সৌন্দর্য্য উপভোগ করেন। পরবর্তীতে বিকাল সাড়ে চারটার দিকে মুন্সিগঞ্জ টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট মাঠে পৌছে পুনরায় হেলিকপ্টারযোগে রাজকুমারী শ্যামনগর ত্যাগ করেন।
এরআগে বেলা ১০টা ১৫ মিনিটে দিকে হেলিকপ্টারযোগে ডেনমার্কের রাজকুমারী ম্যারি এলিজাবেথ ডোলান্ডসন শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট মাঠে অবতরণ করেন। এসময় কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তিনি সড়কপথে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলন কার্যালয়ে পৌছে প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষার পর সুন্দরবন তীরবর্তী কুলতলি গ্রামে পৌছান। ডেনমার্কের রাজকুমারীর শ্যামনগর উপকূলীয় এলাকা পরিদর্শনের যাবতীয় বিষয় এসএসএফ এর পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
কুলতলী গ্রামের পুষ্প রাণী মন্ডল জানান, রাজকুমারীর আগমনে তারা খুবই খুশি। রাজকুমারীর সাথে তাদের কি কথা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কুলতলী খাল খননের ফলে এলাকায় মিষ্টি পানির যোগান বেড়েছে। খালের মিষ্টি পানির বদৌলতে এক ফসলের পরিবর্তে এখন দুটো ফসল হচ্ছে। এসব কথা রাজকুমারীকে বলা হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির টিম লিডার জগদীশ চন্দ্র মন্ডল বলেন, রাজকুমারী ম্যারি এলিজাবেথ ডোনাল্ডসন ঘুরে দেখেছেন কুলতলী এলাকার বেড়িবাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্র। তার কাছে ঝড়-সাইক্লোন- জলোচ্ছ্বাস অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছি।
তিনি জানান, আমি রাজকুমারীকে দূর্যোগকালীন সময়ে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছি। বাড়ি-ঘর ছেড়ে মানুষেরা আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চায়না। কিন্তু যখন দূর্যোগের মুখে পড়ে অসহায় হয়ে পড়ে, তখনই তারা ছাগল-গরু নিয়ে ঝড়ের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে আসে। এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও আরও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের দাবি জানানো হয়েছে বলে জানান টিম লিডার জগদীশ চন্দ্র মন্ডল ।
মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অসীম কুমার মৃধা জানান, রাজকুমারী কুলতলী গ্রামে যেয়ে বেড়িবাঁধের ওপর কিছুক্ষণ হাঁটেন ও আশ্রয় কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেন। পরে কুলতলী গ্রামের মানুষদের সাথে কথা বলেন। গ্রামবাসি তাকে জানিয়েছে, দূর্যোগে ভংগুর বাঁধের জন্য তারা প্রায় প্রতিবছর ঘরবাড়ি হারান। এছাড়া এলাকায় বেকারত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে জানিয়ে তারা বলেন, চিংড়ি ঘেরে লোকবল কম লাগে। অপরদিকে মিষ্টি পানির অভাবে কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। জলাভূমি খনন করে মিষ্টি পানির ব্যবস্থা করে এলাকায় কৃষি ব্যবস্থা আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন চাষিরা।
এমআই