ভাগ্য নিরুপায় যেখানে
ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গেলাম৷ বলা যায় ঈদ ছাড়া গ্রামের বাড়ি আসা হয় না তেমন। তবে নগর জীবনের অস্থিরতায় সবার মত আমারও ইচ্ছে হয় গ্রামে চলে আসি, গ্রামে থিতু হয়ে যাই । কিন্তু সেটা আর হয় না।
গ্রামে গেলে কিছু বাস্তব এবং নিষ্ঠুর বিষয় মনকে ব্যথিত করে। চিকিৎসক হওয়াটাও কেমন জানি একপেশে মনে হয়৷ গ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারে বেহাল দশা৷
এক গরীব কৃষক, সেই আর তার বউ মিলে কৃষিকাজ করে আর গরু পালে। হঠাৎ তার বউয়ের কোমর থেকে এক পা পর্যন্ত ব্যথা। অনেক চিকিৎসক দেখিয়েছে, এম আর আই থেকে শুরু করে তাকে দিয়ে সব পরীক্ষা করিয়েছে৷ ছয়মাসে দেড় লাখ টাকা খরচ। অতি সামান্য উন্নতি৷ ডাক্তার বলেছে, কোন কাজ করা যাবে না, সামনে ঝুঁকতে পারবে না, ওজন নিতে পারবে না। কৃষক এখন নিরুপায়। কি করবে, সে নিজেও জানে না৷ গরু ছাগল সব বিক্রি করে চিকিৎসা করিয়েছে। তারপর উপর বউও কাজ করতে হবে না। এই কথা শুনে, আমি বললাম দূর মিয়া পিএলআইডি সমস্যা, ব্যথা তেথা কম বেশ থাকবেই। এইসব সমস্যায় রেস্টে থাকলে সমস্যা আরো বাড়ে। সব বাদ দিয়ে বউ নিয়ে কাজ শুরু করেন৷ উনি জানে পানি পেল।
গ্রামের অন্যতম আরেক সমস্যা হু হু করে জনসংখ্যা বাড়তেছে এখনো। গ্রামের ধানী জমিগুলো প্রায় নাই হয়ে যাচ্ছে৷ ধানী জমিতে অনবরত ঘর বাড়ি গড়ে উঠছে। তবে ধানী জমি কমলেও ধানের উৎপাদন অনেকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে৷ তাই এটা নিয়ে হেডেক না থাকলেও, হেডেক অন্য জায়গায় আছে৷
যেমন - আমরা আগে অনেক বড় একটা বাড়িতে ছিলাম। বাড়িতে ১০/১২ জন গৃহস্থের ঘর ছিল, আমরা বাড়ির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত দৌড় প্রতিযোগিতা দিতাম। দিন রাতে খেলাধুলা, আনন্দ করতাম। এখন বাড়িতে ৭০/৮০ জন গৃহস্থের বাস৷ বাড়ি ভেংগে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে৷ ছেলেরা মেয়েরা উঠানে মাঠে খেলাধুলা বাদ দিয়ে মোবাইলে গেমস খেলে।
ধানী জমি কমার দুঃখ ঘুচানো সম্ভব হলেও, বাড়ি ভেংগে টুকরো টুকরো হওয়ার দুঃখ ভুলতে পারি না৷ তাই গ্রামের বাড়ি গেলেই বুকটা খা খা করে উঠে। এই যেন প্রকৃতির নিরব প্রতিশোধ আমাদের উপর দিচ্ছে।
পুরো বাড়ি, গ্রামে শিক্ষার কোন বালাই নাই। প্রতি গ্রামে গ্রামে মাদ্রাসা, স্কুল গড়ে উঠেছে। সবাই নামকাওয়াস্তে স্কুলে যায়। ক্লাস নাইন টেন এ পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা ভাল করে বাংলা পড়তে পারে না, ইংরেজি পড়তে পারে না, অংক পারে না। আমার মনে হয় অনেক শিক্ষকরাও ভাল পড়াতে পারে না, কিংবা ইচ্ছে করে অলসতা করে ভাল পড়ায় না, বিশেষত জবাবদিহিতার অভাবে৷
ছেলেরা একটু বড় হলেই বাবা মা বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে । তাদের টাকায় ধানী জমিতে বিল্ডিং উঠতেছে, যৌতুক দিয়ে মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছে৷
বছরের পর বছর ছেলে বিদেশ করতেছে, কোন কোন ছেলে টানা ১০ বছর বিদেশে, একবারও দেশে আসতে পারছে না, বৈধ কাগজ পত্র নেই। চুরি ধারি করে কাজ করে দেশে টাকা পাঠায়। সেই টাকায় দেশের জিডিপি বাড়তেছে হু হু করে ৷ আমার গ্রামের অনেক ছেলে বিদেশের জেলে আছে বহু মাস, বছর ধরে।
মেয়েগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। অল্প বয়সে বিয়ে দিচ্ছে, কয়েক বছর পর স্বামী ৫০ হাজার টাকা দিয়ে তালাক দিয়ে দিচ্ছে৷ আমার নিজ বাড়ির এক মেয়ে আলিম পাশ, সম্পর্কে আমার ভাতিজী হয়। পড়াশুনায় ভাল স্টুডেন্ট। হঠাৎ শুনি বিয়ে হয়ে গেছে, হঠাৎ আবার তালাক। তালাকের কারণ হল মেয়ে নাকি চোখে কম দেখে। ডাক্তার বলেছে মেয়েকে চশমা পরতে হবে।শ্বাশুড়ি এটা কিছুতেই মানতে পারে নাই, আন্ধা মেয়ে তার ছেলের বউ হবে!! চশমা যেহেতু ডাক্তার দিয়েছে, তার চোখে সমস্যা আছে। তাই এই বউ রাখা যাবে না৷ এই আর কি! আমার নিজ বাড়িতে এই ধরনের ঘটনা বেশ কয়েকটি আছে।
গ্রামে আরেকটা জিনিস খুব গভীর হচ্ছে৷ সেটা হল ঋনের জাল। মাইক্রোক্রেডিট কোম্পানি গুলো না বুঝে শোনে লোন দিচ্ছে। এইসব লোনের টাকা দিয়ে কোন উৎপাদন বা উন্নয়ন মুখি কাজ হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে এক জায়গা থেকে টাকা নিয়ে আরেক জায়গায় দিচ্ছে৷ ঘর দিচ্ছে, বসে বসে খাচ্ছে৷ পরের সেই লোনের কিস্তি দিতে পারছে না। অনেকে ঘর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে৷ ব্যাপক হারে এটা হচ্ছে ৷
অনেকে লোন দিয়ে বিদেশে যায়, দালালের খপ্পরে শূন্য হাতে দেশে ফিরে। এখন সে কিভাবে লোন পরিশোধ করবে? এর জন্য কেউ কেউ আত্নহত্যাও করতেছে৷
মাঝে মাঝে ভাবি আমি তো এদেরি প্রতিচ্ছবি৷ ভাগ্যক্রমে কিছুটা পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছি, যার জন্য এই লেখা লিখতে পারছি । অন্যরা সেটা পায় নাই! শুধু এইটুকু পার্থক্য।
গ্রামের শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যবস্থা আর কত অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে৷ নিজের মনের ভিতর অপরাধ বোধ হচ্ছে৷ গ্রামের আলো বাতাস খেয়ে বড় হয়েছি, কথিত শিক্ষিত হয়েছি। অথচ গ্রাম থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি৷