সময় জার্নাল ডেস্ক: দেশের ১১টি জেলা ইতোমধ্যে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, হবিগঞ্জ ছাড়া সিলেট অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি আগামী ২৪ ঘণ্টায় স্থিতিশীল থাকতে পারে। অন্য দিকে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের নদীগুলোর পানি বাড়ছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, গতকাল সোমবার সকালে ৯টি নদ-নদীর পানি ১৯টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রাম নগরীর বেশির ভাগ এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় সড়কে চলছে নৌকা। সিলেট ও সুনামগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পানি নতুন করে না বাড়লেও বানভাসি মানুষের দুর্গতির কমতি নেই। সিলেট নগরীর নিম্নাঞ্চলের বাসাবাড়ি ও রাস্তাঘাট এখনো তলিয়ে রয়েছে।
নেত্রকোনায় উজানের ঢলের পানি অব্যাহত থাকায় সেখানে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বিভিন্ন জেলার আশ্রয় কেন্দ্রসহ দুর্গম এলাকায় পানিবন্দী মানুষের খাদ্য, বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট বেড়েই চলেছে। ঘরবাড়ি আর ফসল হারানো মানুষের হাহাকারও বাড়ছে। এদিকে সংশ্লিষ্ট দফতর এবার দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বন্যার পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা জানিয়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। ফলে ওই সময়ে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, ধরলা ও দুধকুমারসহ সব প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। তবে ভারতের মেঘালয় প্রদেশে ভারী বর্ষণের প্রবণতা কমে এসেছে।
তিনি বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। অন্য দিকে হবিগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে। তিনি বলেন, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এ সময়ে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অতিভারী বৃষ্টির আশঙ্কা আছে জানিয়ে আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, এর ফলে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার নদ-নদীগুলোর পানি সমতল দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।
সিলেটবাসীর দুর্ভোগ দীর্ঘ হচ্ছে। সুরমা নদীর পানি ধীরে ধীরে কমলেও সিলেটে বন্যার সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। প্লাবিত এলাকার বেশির ভাগ এখনো পানির নিচে রয়েছে। সিলেট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম জানান, সুরমা নদীর পানি কমলেও কুশিয়ারার পানি বাড়ার কারণে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কিছু এলাকা নতুন করে প্লাবিত হতে পারে। এ ছাড়া গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, সদর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ উপজেলা প্লাবিত এলাকার পানি ধীরে ধীরে কমছে বলে জানান তিনি।
এ দিকে পুরোপুরি নিরাপদ অবস্থানে ফিরল সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুৎকেন্দ্র। রানওয়ে থেকে পানি নামলেও অ্যাপ্রোচ লাইট এখনো পানির নিচে তলিয়ে থাকায় সচল হচ্ছে না সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফ্লাইট চলাচল।
অন্য দিকে, নেত্রকোনা সংবাদদাতা জানান, অব্যাহত পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। আরো নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। প্লাবিত ১০ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা, সুসং দুর্গাপুর, হাওরাঞ্চলের খালিয়াজুরি ও মোহনগঞ্জ উপজেলা। জেলা প্রশাসন জানায়, ১০ উপজেলার ৬২টি ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ২৬৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে এ পর্যন্ত ৫০ হাজারের অধিক নারী-পুরুষ আশ্রয় নিয়েছেন। সীমান্তের পাহাড়ি নদী মোমেনশ্বরী, কংশ, ধনু, গনেশ্বরী, উব্দাখালী, মঙ্গলশ্রী, মহাদেও ও মগড়া নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুলাউড়ার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। রোববার রাত ও সোমবার ভোর থেকে আবারো বৃষ্টিপাত হওয়ায় নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ করে কুলাউড়া পৌরসভার অধিকাংশ এলাকা এখন প্লাবিত। সরকারি হাসপাতাল, খাদ্য গুদাম, উপজেলা চত্বরসহ বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে পানি ওঠায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষ। বন্যাদুর্গতরা ত্রাণের অভাবে চরম অসহায় জীবনযাপন করছেন।
সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ হার্ডপয়েন্টে আরো ২১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৩৩ এবং কাজিপুরের মেঘাই ঘাট পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে টানা তিন সপ্তাহ দু’টি পয়েন্টেই পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার বন্যাকবলিত ছয়টি উপজেলার ৩২টি ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এতে বিশুদ্ধ পানির অভাবসহ বিভিন্ন সঙ্কট দেখা দিচ্ছে বানভাসিদের মাঝে। এ দিকে বাঁধ অভ্যন্তরের এ পরিস্থিতিকে বন্যা বলে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানালেও বন্যা মোকাবেলায় প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়।
কুড়িগ্রামে পানিবন্দী দেড় লক্ষাধিক মানুষ। কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অন্তত দেড় লাখ মানুষ। এ অবস্থায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে দুর্গম চরাঞ্চলের বন্যাকবলিত মানুষজন।
নীলফামারী সংবাদদাতা জানান, হু হু করে বাড়ছে তিস্তার পানি। সোমবার বেলা ৩টা থেকে তিস্তার পানি নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পাউবোর পানি পরিমাপক নূরুল ইসলাম জানান, সোমবার বেলা ১১টার পর থেকে বাড়তে থাকে তিস্তার পানি। দুপুর ১২টায় বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ও বেলা ৩টায় পানি বৃদ্ধি পেয়ে ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে।
তিস্তা অববাহিকায় বন্যার অবনতি হয়েছে। গজলডোবার গেট খুলে দেয়ায় উজানের ঢল ও বর্ষণে তিস্তার পানি বিপদসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় তিস্তা অববাহিকায় বন্যার অবনতি শুরু হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিস্তার পানি আরো বাড়বে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তিস্তায় পানি বৃদ্ধি শুরু হওয়ায় নীলফামারীর ডিমলার ছাতনাই এলাকা থেকে জলঢাকা, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম হাতীবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারী, সদর, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুরের ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত অববাহিকার ৩৫২ কিলোমিটার এলাকার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
সময় জার্নাল/এলআর