সাইফুল ইসলাম হৃদয়:
কোরবানি অর্থ নৈকট্য, আত্মত্যাগ। কোরবানি ইদ অর্থ হলো ত্যাগের উৎসব ।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সকল সম্প্রদায়ের জন্য আমি কোরবানির বিধান দিয়েছি, তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণস্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা-হজ, আয়াত: ৩৪)।
কোরবানির ইতিহাস কম-বেশি সকলেই আমরা জানি। হযরত ইব্রাহিম আঃ মহান রাব্বুল আলামিনের কঠিন এক পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন। আল্লাহর আদেশ প্রাপ্ত হয়েছিলেন "নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি করার জন্য"। ইব্রাহিম আঃ উনার প্রিয় সন্তান হযরত ইসমাইল আঃ কে নিজের জীবনের চেয়ে অধিক ভালোবাসতেন৷ আল্লাহর আদেশ প্রাপ্ত হয়ে প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল আঃ কে কোরবানি করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইব্রাহিম আঃ এর ঈমানের পরীক্ষা নিচ্ছিলেন যে উনি পরম প্রিয় পুত্রকে আল্লাহর আদেশে কোরবানি করতে বিচলিত হন কিনা? মায়ায় জড়ান কিনা? ইব্রাহিম আঃ সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। যেইমাত্র ইসমাইল আঃ কে কোরবানি করতে যাবেন তখনই এর পরিবর্তে আল্লাহর পক্ষ থেকে জান্নাতি পশুর কোরবানি হলো।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরানে কোরবানি করতে বলেছেন। কোরবানি আবার সকলের জন্য নয়৷ স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক, মুসলিম যদি ‘নিসাব’ পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকেন, তাঁদের পক্ষ থেকে একটি কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব বা আবশ্যক। নিসাব হলো সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এর সমমূল্যের নগদ টাকা ও ব্যবসার পণ্য বা সম্পদ।
তবে বর্তমান সমাজে কোরবানির নামে লোক দেখানো দামি গরু জবাই দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। বিষয়টি অপ্রিয় হলেও সত্য। ঋণে জর্জরিত ব্যক্তি অথচ লোকে কি বলবে এই ভয়ে কোরবানি করছেন অনেকে। এতে করে কোরবানির মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছি আমরা৷
বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে এসেছে জিলহজ্জ মাসের চাঁদ উঠার পর থেকে কোরবানির আগের দিন পর্যন্ত বিভিন্ন আমলের কথা৷ অনেক বিজ্ঞ আলেম এই সময়ে রোজা রাখা, নিয়মিত সালাত আদায়, বিভিন্ন নফল ইবাদত, সহ নিয়মিত ইবাদতের ফজিলত ও ইবাদতের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
বান্দা এই সময়ে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ নিকটবর্তী হবে পাশাপাশি নিজের আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন করবে। এর মাধ্যমে ব্যক্তি তার অন্তরে থাকা কলুষিত নফস তথা পশু ভাবকে বর্জন করতে পারবে আল্লাহর দয়ায় এবং ইচ্ছায়।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন -
মনের পশুকে করো জবাই
পশুরা ও বাঁচে ; বাঁচে সবাই।
এই কথাটির মাঝে একটি বিশেষ তাৎপর্য লুকায়িত রয়েছে। সেটি হলো ; আগে আপনি আপনার ভিতরের পশু সত্ত্বাকে হত্যা করুন, নফসকে পবিত্র করুন , মনের পশুকে জবাই করুন তারপর এই দেহধারী পশুকে জবাই দিন।
এতে করে কোরবানি সত্যিকারে অর্থবহ হবে।
লক্ষ্য করুন প্রিয় পাঠক ; জিলহজ্জ মাসের দশদিনের ইবাদতের সাথে কিন্তু মনের পশুকে জবাই করার মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে৷
আপনি যদি আপনার মনোবৃত্তি তথা নফসের কুপ্রবৃত্তির উপর জয় লাভ করতে পারেন তবেই আপনার মনের পশুর সত্যিকারের কোরবানি হবে।
জিলহজ্জ মাসের এই ফজিলত পূর্ণ সময়ে আল্লাহর অশেষ রহমত যদি আপনি পেতে পারেন ইবাদতের মাধ্যমে তবে আপনার নফসের উপর আপনার বিজয় সম্ভব, তথা মনের পশুকে কোরবানি করা সম্ভব।
এবার আসি লোক দেখানো কোরবানির বিষয়ে -
একটু চিন্তা করে দেখুন এই যে আমরা পশু কোরবানি করি এতে সবচেয়ে বেশি ত্যাগটা কে স্বীকার করে? আপনি? নাকি পশু? পশুই কিন্তু সর্বোচ্চ ত্যাগটুকু করে। সে তার রক্ত দেয়, চামড়া দেয়, মাংস দেয়, হাড় দেয়, পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করে। আপনি কি করেন? আপনি পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করেন। সেই অর্থ ব্যয় করেন এইতো? আর কিছু? আর কিছুই না। আপনি কিন্তু অর্থের বিনিময়ে মাংস নিচ্ছেন। কিছু মাংস বিতরণ করে বাহবা পাচ্ছেন ( লোক দেখানোর চিন্তা করলে)। তাছাড়া অমুক ভাই তো এক লাখ দিয়ে দিচ্ছে এই প্রশংসা তো শুনছেনই।
আসলে সবমিলিয়ে একটু ভেবে দেখুন -
আপনি যদি লোক দেখানো, বাহবা পাওয়া, মাংস খাওয়া, এসবের জন্য কোরবানির নিয়্যত করেন তবে এটা কোরবানি হতে পারে না। এটা হয় একটা নিরীহ পশু হত্যা।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর নিকট ওদের গোশত রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ৩৭)।
অর্থাৎ এই তাকওয়া অর্জন ব্যতীত কোরবানি পরিপূর্ণ হয় না।
কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হলো ত্যাগ করা। একটা পশুর গলায় ছুরি চালানোর আগে নিজের নফসের কুপ্রবৃত্তিকে হত্যা করা উচিত। নিজের মনের পশুকে কোরবানি দিয়ে একটা পশুকে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে কোরবানি দেয়াই সত্ত্যিকারের কোরবানি। এতে দুটি বিষয় হয় ; প্রথমত একজন পরিশুদ্ধ মানুষের জন্ম হয় অন্যদিকে যে উদ্দেশ্যে কোরবানি দেওয়া তার উদ্দেশ্য প্রকৃত অর্থে হাসিল হয়।
তাই কোরবানি হোক মনের পশুর ও। আল্লাহ সকলের কোরবানি কবুল করুক৷
আমিন।
লেখক: সাইফুল ইসলাম হৃদয়
কবি ও প্রকৌশলী।