দুলাল বিশ্বাস, শিক্ষক ও সাংবাদিক:
ঘাতক ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতুর ক্রিকেট স্ট্যাম্পের আঘাতে মৃত্যুবরণ করেছেন শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার।শিক্ষকের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে অবাক হয়েছে দেশবাসী। হতাশায় নিমজ্জিত পুরো শিক্ষক সমাজ। একজন শিক্ষকের এরকম অকাল মৃত্যু যা খুবই দুঃখজনক এবং কষ্টদায়ক। খুবই দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে যখন লেখাটি লিখছিলাম তখন চোঁখ বেয়ে জল গড়িয়েছে অনেকবার। বিষয়টি চিন্তা করলে বাঁচতে ইচ্ছে করে না। মরে যেতে ইচ্ছে করে। ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে শিক্ষকতা পেশা। ঢাকা সাভারের চিত্রশাইলে অবস্থিত হাজী ইউনুস আলী স্কুল এন্ড কলেজ শাখায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন উৎপল কুমার সরকার।
দায়িত্বপালন করা অবস্থায় ওই প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতি হাজি হযরত আলী সাহেবের ভাগ্নে উজ্জ্বল হাজির ছেলে দশম শ্রেনীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু একটি মেয়েকে নিয়ে বেহায়াপনা করে এবং সে বিভিন্ন সময়ে ছাত্রীদেরকে উত্ত্যক্ত করতো যা শিক্ষক হয়ে মেনে নেবার নয়। ছাত্রের বেহায়াপনা এবং একটি মেয়ের সাথে প্রেমঘটিত সম্পর্কের ব্যাপারে ঘাতক জিতুর পরিবারকে অবগত করেছিলেন তিনি। যাতে তার পরিবার তাকে শাসন করে এবং ঘাতক ছাত্রটিকে এসমস্ত অছাত্রসুলভ অপকর্ম থেকে বিরত রাখে। এরপর শিক্ষকের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ২৫ জুন শনিবার ২ টা ৩০ মিনিটে ছাত্রীদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলাকালীন শৃংখলা রক্ষায় দায়িত্বরত অবস্থায় ঘাতক ছাত্র তাকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে মাথায় এবং পেটের বিভিন্ন অংশে আঘাত করলে শিক্ষককে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হলে পেটে অস্ত্রোপচার হয় এবং ১৬ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ২৭ জুন সোমবার সকাল পাঁচটায় মৃত্যুবরণ করে তিনি। স্যার, বয়স বিবেচনায় আপনার হত্যাকারীর বিচার দেশের বিদ্যমান আইনে নাও হতে পারে। আপনার হত্যাকারীর ফাঁসি চাই। মারাত্মকভাবে আহত অবস্থায় যদি শিক্ষক জীবিত থাকতেন তাহলে বরং আপনাকেই বিচারের সম্মুখীন করা হতো। আপনার দায়িত্ব সম্বন্ধে নিম্নলিখিত বাস্তবতার নিরিখে অবগত থাকলে হয়তো আপনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করতে পারতেন।
ছাত্র-ছাত্রী হাজারো অপরাধ করলেও শিক্ষকরা তাদের শারীরিকভাবে কোনরূপ শাস্তি দিতে পারবেন না। শিক্ষার্থী মনে কষ্ট পাবে এমন কোন গালি, কটুকথা কিংবা ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করে বকা বা শাসন করা যায় না।
শিক্ষার্থী মাতাল অবস্থায় কিংবা স্কুল ব্যাগে করে মোবাইল, মাদকদ্রব্যসহ নিষিদ্ধ পণ্যসামগ্রী সাথে নিয়ে শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করলেও শিক্ষক তাকে শাসন করতে পারেন না। সহপাঠীকে মারধর, ইভটিজিং, ছাত্রীদের উত্যক্ত করা এবং জনসম্মুক্ষে মেয়েদেরকে কুপ্রস্তাব দেওয়া, অশ্রাব্য গালিগালাজ, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে বেয়াদবি, নিজ বাবা-মার গায়ে হাততোলাসহ নানা অসভ্যতা ও অছাত্রসুলভ আচরণ করলেও তাকে শাস্তি দেওয়া যায় না।
মাধ্যমিক পর্যায়ে যেসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ বা ছাত্ররাজনীতি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু আছে সেসব প্রতিষ্ঠানের ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেনীতে পড়–য়া ছাত্রনেতাদের প্রতি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকদের করনীয় কি তা আজ শিক্ষক সমাজ বুঝে উঠতে পারছে না।তাদেরকে আচরণ এবং শৃঙ্খলা শেখাতে গিয়ে শিক্ষকরা অপমানিত হচ্ছেন। বলা যায়, মাধ্যমিক লেভেলের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি এবং ছাত্র সংগঠন সক্রিয় থাকলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাড়াবে তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ভালো জানেন।
একজন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে পেশাগত আচরণ শিক্ষা দেওয়ার জন্য যা যা নির্দেশনা দেয়া দরকার তার সবই সরকারের পক্ষ থেকে জারি করেছেন। কিন্তু একজন শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ভাঙলে তার শাস্তি হবে কিনা এবং প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালে শিক্ষার্থীর আচরণ কেমন হবে সে ব্যাপারে সঠিকভাবে তেমন কোনো দিক নির্দেশনা দেওয়া নেই।
বখাটে ছাত্র কোনো ম্যাডামকে কুপ্রস্তাব দিলেও শিক্ষক হিসেবে আপনি তাকে শাস্তি মূলক কোনো ব্যবস্থা দিতে পারবেন না । তাদের কিশোর গ্যাং আছে। আপনার ঘাতক ছাত্রটি স্থানীয় একটি কিশোর গ্যাংয়ের প্রধান হিসেবে এলাকায় বিভিন্ন অসামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।
ছেলে বা মেয়ে সন্ত্রাসী হলে তার পরিবারের কোনো মাথাব্যথা না হলে শিক্ষকের কি যায় আসে। অপরাধী ছাত্রটির পিতৃ পরিচয় জানার পরও কেন এই রিক্স নেওয়া ঠিক হয়নি ওই স্যারের। এখন কে দেখবে আপনার পরিবার ? আপনার-আমার প্রমোশনহীন যে চাকরি একজন ছাত্র-ছাত্রী বা তার অভিভাবকের অদৃশ্য কোনো অভিযোগের উপর ভিত্তি করে যে কোন সময় চলে যায় সেই চাকরিতে একজন বখাটে শিক্ষার্থীকে মানুষ করার কোন ক্ষমতা বা দায়িত্ব আপনার আমার মতো শিক্ষককে দেয়া হয়নি।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় "সন্তান যার শাসন শুধুই তাঁর"। শিক্ষকগন শুধুমাত্র চোখ বন্ধ করে সিলেবাস শেষ করে দিবেন জিপি এ -৫ পাওয়ার জন্য। এসব আপনার জানা উচিত ছিল। মানবতাহীন জিপি এ -৫ পাওয়া এসব শিক্ষার্থীদের নিয়ে কোন পথে এগোবে এই দেশ তা ভাবার দায়িত্ব কি শুধুই আপনার কিংবা শিক্ষকের? আপনার অপমৃত্যু হলে এদেশের শিক্ষক সমাজ বা শিক্ষক নেতারা এক হতে পারবেন না। আপনার অপমৃত্যুতে কারো কিছু যায় আসে না। এটা আপনার জানা উচিত ছিল। যে সন্তান তার বাবা-মা কিংবা পরিবারের কারও শাসনই শোনেনা-মানেনা সে আপনার শাসন কেন শুনবে-মানবে?
সততা, ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার শেখাতে গেলে যদি শিক্ষকের জীবন চলে যায়, তবে কেন বখাটেদের মানুষ করতে বৃথা চেষ্টা করবেন ? এগুলো শেখানোর জন্য পরিবার আছে, বই আছে, ফেসবুক আছে, মোবাইল ফোন আছে, টুইটার আছে, কম্পিউটার আছে এবং সর্বোপরি থানা পুলিশ আছে। আজকাল সমাজের বেশিরভাগ বৃদ্ধ বাবা-মা ছেলেদের যতœ থেকে বঞ্চিত। ছেলে এবং ছেলের বউরা কি ছাত্রজীবন পার করে আসেনি? তাদের শিক্ষকরা কি তাদেরকে নীতি নৈতিকতার শিক্ষা দিতে পেরেছেন? আমরাও পারছি না।
শিক্ষার্থীকে জিপিএ-৫ পাওয়ানোর জন্য আপনাকে বেতন দেওয়া হতো, শাসনের জন্য নয়। এটা কি জানতেন না ? একজন শিক্ষার্থীকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মহান ব্রত নিয়েই একজন শিক্ষক তার স্বীয় পেশায় নিয়োজিত হন। আপনি কি পেলেন? এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। দক্ষ ও সুযোগ্য যুবসমাজ গড়ে তোলার দায়িত্ব সরকারের, শুধুমাত্র আপনার কিংবা শিক্ষকদের নয়। সরকারই নির্ধারন করবে কিংবা তাদের সিদ্ধান্তগুলোই ঠিক করবে তারা। কেমন ছাত্রসমাজ তথা যুবসমাজ চান! এ বিষয়গুলো আমলে নিলে ভালো করতেন।
কলেজ এবং ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষককে বেইজ্জতি বা মারধরের বা হত্যার ঘটনা বহুবার ঘটেছে। এখন মাধ্যমিক লেভেলেও আপনাকে হত্যার মাধ্যমে শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক হত্যা শুরু হলো যা এই পেশায় নিয়োজিত পেশাজীবী লোকদের জন্য এক অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে। নিজে ওপারে নিশ্চৗেল্প ঘোমাচ্ছেন। আমাদের চোঁখের পানি মুছে দিবে কে।
যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি যে, ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের হত্যাকে কোনো সংখ্যালঘু হত্যা হিসেবে আন্তর্জাতিক চক্রান্তমুলক হত্যাকান্ড হিসেবে বিবেচনা না করে এই হত্যাটিকে একটি শিক্ষক হত্যা হিসেবে আমলে নিয়ে ঘাতক আশরাফুল ইসলাম জিতুকে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচনা না করে তাকে পরিপূর্ণ হত্যাকারী হিসেবে (বয়স ১৯ বছর) তাকে দৃষ্টান্তমুলক সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। কোনো পর্যায়েই যেন এমন ঘটনার পুনরাবৃতি না ঘটে তারজন্য প্রয়োজনে কঠোর এবং প্রয়োগযোগ্য আইন করে তা সুনিশ্চিত করতে হবে। স্বীকার করি আর স্বীকার না করি আমাদের দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ঘাতক আশরাফুল ইসলাম জিতুর মতো বখাটে বিকৃত মনের অধিকারী শিক্ষার্থী আছে। বখাটে উশৃংখল শিক্ষার্থীরা যখন জানবে শিক্ষক মেরে ফেললেও শাস্তি হয় না বরং লঘুদন্ড হয় তখন পরিস্থিতি কেউ সামাল দিতে পারবেনা। অচল হয়ে পড়বে দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা।