শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

জাপানের লোডশেডিং

বৃহস্পতিবার, জুলাই ২১, ২০২২
জাপানের লোডশেডিং

আশির আহমেদ:

জাপানে কি লোড শেডিং হয়? হয়না মানে। প্রতি মিনিটে মিনিটে হয়- আমার সবজান্তা বন্ধুর ঝটপট উত্তর। আমি ভাবলাম, ৩৩ বছর জাপানে আছি, মাত্র ৩ বার কারেন্ট যাবার কাহিনি দেখেছি। এসব সে কি বলে? আমি নিশ্চিত সে অন্য কিছু বোঝাতে চায়। সে বললো- আগে দেখ লোড শেডিং এর মানে বুঝস কিনা। আমি ফেসবুকে সমস্ত বন্ধুদের জিজ্ঞাস করলাম। লোডশেডিং এর মানে কি, এটার বাংলা কি। কত সুন্দর সুন্দর উত্তর। বুয়েটের ছোট ভাই পরিভাষায় দক্ষ শাহেদ বললো- “Load(ভার) Shedding( কমানো)"। বিদ্যুতের ওপর ভার কমানো কে লোড শেডিং বলা হয়। 

২০ বছর আগের কথা। আমার এক জাপানি বন্ধু কে নিয়ে বাংলাদেশে গেছি। বাসায় হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল। সে আকাশ থেকে পড়লো। একি? কারেন্ট আবার যায় নাকি? আকাশ থেকে পড়া জাপানি কে আমি আকাশের কাছাকাছি নেবার জন্য ছাদে উঠলাম। সারা ঢাকা শহর অন্ধকার। আকাশে কি সুন্দর তারা। আমরা তাকে লোড শেডিং এর কাহিনি বোঝালাম। সে বলে উঠলো - এটা তো Power Outage। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার বাপজান এসে যোগ দিলেন। লোড শেডিং টা ব্রিটিশ ইংরেজি। আমেরিকা তে বলে পাওয়ার আউটেজ- যার মানে হল কারেন্ট চলে যাওয়া। বিদ্যুৎ কেটে দেয়া।  তারপর সূত্রতে ঢুকলেন।  ওহমের সূত্র মনে আছে? মনে আছে, কিন্তু উচ্চারণ টা ওহম না। কেন জানি বাংলাদেশে বিদেশি বৈজ্ঞানিকদের নাম জঘন্য ভাবে উচ্চারণ করে। জাপানে এমনিতেই যথেষ্ট ব্যাঞ্জনবর্ণ নেই। জাপানিদের মুখে বিদেশি নামের  উচ্চারণ শুনলে রীতিমত গা জ্বালা করে। কিন্তু এরা বৈজ্ঞানিকদের নাম গুলোর আসল উচ্চারণ কে মাথায় রেখে সীমিত জাপানি অক্ষর দিয়ে সাজিয়ে নেয়। যেমন  Cumilla দেখে এটাকে চুমিল্লা পড়বে না, বাংলাদেশি দের জিজ্ঞাস করবে তোমরা কিভাবে উচ্চারণ করো? সেই উচ্চারণে জাপানি কায়দায় উচ্চারণ করার চেষ্টা করবে। জার্মানি বৈজ্ঞানিক ওহম এর আসল উচ্চারণ ও-ম। হ এর উচ্চারণ নেই। তবু ও কাছাকাছি। Kirchhoff নামের আরেকজন জার্মান বৈজ্ঞানিক আছেন যার উচ্চারণ বাংলায় কার্সফ বলে বুয়েটের শিক্ষকদের মুখে শুনে এসেছি। এর আসল উচ্চারণ কীরখহফ। সেদিন দেখলাম একজন জনপ্রিয় বিজ্ঞান প্রমোটার শ্রোডিঙ্গার কে শ্রোডিঞ্জার বলছেন। 

আমার সবজান্তা বন্ধুর মতে, বাংলায় আমরা ইংরেজি শব্দ থেকে উচ্চারণটা করি, সেই দেশের আসল ভাষার উচ্চারণ টা করি না।  আহারে বুঝলাম তো। লোড শেডিং এর কথা বল।  বৈজ্ঞানিক ও-ম সাহেব  (ছিলেন একজন স্কুল টিচার) বলেছেন - কারেন্ট কে লোড দিয়ে পুরন দিলে যা হয় তা হল ভোল্ট। যেটা বিদ্যুতের পাওয়ার এর সাথে সম্পর্ক আছে। সুতরাং লোড যত কম হবে পাওয়ার তত কম খরচ হবে। লোড মানে হল বিদ্যুৎ বাতি, ফ্যান, এসি যা বিদ্যুৎ তারে ঝুলিয়ে দিলে কারেন্ট খাবে - সেইসব। বিদ্যুৎ দিয়ে যা চালাবেন সবই লোড। কয়েকদিন পর যে মেট্রোরেল চলবে সেটা ও লোড। 

এখন কথা হলো লোড কমাবেন কি করে?  দুইটা উপায় আছে। লোড গুলোকে সব কাট করে দেয়া । অথবা লোড গুলো যেন কম বিদ্যুৎ খায় তার ব্যবস্থা করা। জাপানে লোড শেডিং কিভাবে প্রতি মিনিটে মিনিটে হচ্ছে তাঁর উদাহরণ দিচ্ছি। এখানে শেডিং হয় আউটেজ হয় না। কারেন্ট চলে যায় না। বিদ্যুৎ কাটে না। 

(১) এসির তাপমাত্রা - জাপানে সেই ১০ বছর আগে থেকেই গ্রীষ্মকালে এসির তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি করে রাখার জন্য অনুরোধ করে এসেছেন। এবং মোটামুটি সবাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন। ২৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় অত অস্বস্তি হয় না। সীমিত বিদ্যুতের ওপর লোড কমে। লোড শেডিং। 

(২) লিফট - জাপানে মোটামুটি প্রত্যেক লিফটের গায়ে লেখা থাকে, যদি উপরে ২ তলা পরিমাণ উঠতে হয় অথবা ৩ তলা পরিমাণ নামতে হয় তাহলে উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি ব্যবহার করুন। বিদ্যুতের ওপর লোড কমান। লোড শেডিং। 

(৩) টোকিও আর্বান ডিজাইন - টোকিও আর্বান ডিজাইনের দায়িত্ব দিয়েছেন জনপ্রিয় আর্কিটেক্ট তাদাও আনদো কে। প্রাকৃতিক আলো বাতাস ব্যবহার করে কিভাবে বিল্ডিং ডিজাইন করা যায় তা বহু বছর আগে থেকেই আর্কিট্যাকচার ছাত্রদের পড়ানো হয়। ওনার একটা ইন্টার্ভিউ শুনেছি। সেখানে আরো কিছু সংযোজন করেছেন। দুটো বিল্ডিং এর মাঝখানে যখন বাতাস প্রবাহিত হয় সেই বাতাস কে বলে "বিরু কাযে" মানে হল আন্ত-বিল্ডিং হাওয়া। এই হাওয়া কে কন্ট্রোল করা যায়। আন্ত-বিল্ডিং এর দূরত্ব আর শেপ দিয়ে। একই বাতাস কিন্তু বিল্ডিং এর শেপ আর স্পেস এর কারণে প্রাকৃতিক বাতাসের বেগ কম বেশি করানো যায়। এয়ার সার্কুলেশন বা বাতাস আন্দোলন। বাংলাদেশে ও  গ্রামীণ-ইন্টেল একটা কম খরচের এয়ার কন্ডিশন বানিয়েছিলেন। বিদ্যুৎহীন। ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়া যায় এই টেকনোলোজিতে। কতগুলো প্লাস্টিকের কোকের বোতল  ফানেল এর মত করে কেটে নিয়ে সাজিয়ে দিলে মোটা অংশ দিয়ে বাতাস ঢুকে সরু অংশ দিয়ে বের হয়। এতে বাতাসে গতি বাড়ে। চাপ কমে। চাপ কমলে তাপমাত্রা কমে। এটা যেন কার সূত্র ? পাস্ক্যাল? ঐ যে চাপ তাপমাত্রার সমানুপাতিক। 

(৪) পোশাক - জাপানিরা সাধারণত অফিসে স্যুট-টাই পরে আসতেন। এসির তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি রেখে আরো আরামপ্রদ করার জন্য পোশাকের ডিজাইন এবং উপাদানের ওপর নজর দিলেন। নাম দিলেন কুল-বিজ। শার্ট, গেঞ্জি, আন্ডার-গারমেন্ট সব কুল-বিজ ডিজাইন বের হল। যেদিন গ্রামীণ-ইউনিক্লো সাইন করলেন, সেদিন ইউনিক্লোর প্রেসিডেন্ট য়ানাই সান প্রফেসর ইউনুসকে তাঁর স্বপ্নের কথা বললেন। পোশাক মানুষের জন্য সভ্যতার প্রতীক। যখন ফ্যাশন নামক আভিজাত্য পোশাক শিল্পতে ঢুকল তখন পোশাকের অপচয় বাড়ল। সাথে সাথে ঐকিক নিয়মে দাম ও বাড়ল। আমরা চাই কম খরচে আরাম দায়ক পোশাক। একই আদলে জাপানে তৈরি হয় মুজি (Muji) নামক এক কোম্পানি। মু মানে “নো” জি মানে “প্রতীক বা ব্র্যান্ড”। কোন ব্র্যান্ড নেই এটাই ব্র্যান্ড। সস্তা কিন্তু আরামদায়ক পোশাকের জন্য এরা সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে গেল। গরম কালে এসব পোশাক পরলে ২৬ ডিগ্রি এসি হোক অথবা বাইরে হাঁটেন, শরীরে কুল ভাবটা থাকবে। বিদ্যুতের ওপর লোড কমবে। লোড শেডিং। 
(৫) সৌর বিদ্যুৎ - জাপানে ২০১১ সালে পারমানবিক চুল্লীতে দুর্ঘটনার পর সৌর বিদ্যুতে মনোযোগ বাড়ালেন। নতুন যত বাড়ি বানানো হচ্ছে তাঁর মোটামুটি সব গুলোতে সৌর বিদ্যুতের অপশন থাকে। বিদ্যুতের উপর যেন লোড কমে। লোড শেডিং। 
একসময় আমাদের বাংলাদেশের গ্রামীণ শক্তি ছিল পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় হোম সোলার সিস্টেম প্রোভাইডার। ২০১২ সালে তাদের সাবস্ক্রাইবার ছিল ১ মিলিয়ন। ২০১৪ সালে ওনারা নিজেদের রেকর্ড নিজেরা ভঙ্গ করেন। সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা দাঁড়ালো ২ মিলিয়ন। তারপর আর বাড়ল না। যেই গতিতে সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা বেড়েছিল তাঁর ২০ গুণ গতিতে কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় চলে এলো। ২ মিলিয়ন পুরন ২০০ ওয়াট হলে আজ ৪ বিলিয়ন ওয়াট তৈরি হতো শুধু গ্রামীণ শক্তি থেকেই। বেঁচে যেত বিদ্যুতের ওপর লোড। লোড শেডিং। 

লোড শেডিং মানে বিদ্যুৎ কেটে দেয়া না। ভার কমিয়ে দেওয়া যাতে বিদ্যুতের কারণে গুরুত্বপুর্ন কাজ গুলো বাধা প্রাপ্ত না হয়। 
বিদ্যুৎ না কাটা মানে একজন ডাক্তারের হাতে একটা মুমুর্ষু রোগীর অপারেশন বন্ধ না হওয়া। একজন সন্তান সম্ভবা মায়ের কষ্ট না বেড়ে যাওয়া।  বিদ্যুৎ না কাটা মানে ফ্রিজে থাকা ঔষধ নষ্ট না হয়ে যাওয়া। 

সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সংসদে বসে ঘণ্টায় ৭০ হাজার টাকার বিদ্যুৎ নষ্ট করে বন্দনা গান না গেয়ে পলিসির কথা বলুন। সরকারের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকলে হবে না। সবার সহযোগিতা দরকার।

সময় জার্নাল/এমআই 


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল