নিজস্ব প্রতিবেদক:
সন্ধ্যা ৬টা। দিনভর ব্যস্ত মানুষদের তখন বাসায় ফেরার তাড়া। তড়িঘড়ি করে কেউ পায়ে হেঁটে আবার কেউ কেউ বাসে-রিকশায় প্রাইভেটকারে ছুটছেন। কাওরান বাজারের ট্রাফিক সিগন্যাল সবে ছেড়েছে। যানজটে আটকে থাকা যানবাহনগুলো চলা শুরু করেছে। একই যানজটে আটকা তানজিল বাসে বসে ছিলেন এক নারী শিক্ষার্থী। পাশের সিটে তার ক্লাসের এক বন্ধুও ছিলেন। ওই শিক্ষার্থী তখন জানালার পাশে বসে ভিডিও কলে পরিবারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এমন সময় এক ছিনতাইকারী টান দিয়ে মোবাইল নিয়ে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীও ছিনতাইকারীর পিছু পিছু ছুটেন।
যানবাহনের ফাঁকে ফাঁকে কিছুদূর যাওয়ার পর খেই হারিয়ে ফেলেন। হারিয়ে যায় কালো টি-শার্ট পরা সেই ছিনতাইকারী। কাওরান বাজারের প্রধান সড়কের পাশের ইত্তেফাক গলিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। নিজের পছন্দের শাওমি ব্র্যান্ডের পোকো এম-৩ সেটটি ছিনতাই হওয়ার কষ্টটা যেন তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। সহপাঠী বন্ধুকে নিয়ে তখন ওই গলিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঠিক তখনই আরেক ছিনতাইকারী মোবাইল ছিনতাই করে এই গলি দিয়ে যাচ্ছিল। আর তার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছিলেন মোবাইলের মালিক। ওই শিক্ষার্থী তখন দেখছিলেন তার সামনে দিয়ে ছিনতাইকারী পালিয়ে যাচ্ছিল। কিছু ভেবে উঠার আগেই ছিনতাইকারীকে জাপটে ধরেন। তারপর শুরু করেন বেধড়ক পিটুনি। পেটাতে পেটাতে রক্তাক্ত করে ফেলেন। সঙ্গে কান্নাকাটি আর চিৎকার করে বলতে থাকেন তার ছিনতাই হওয়া ফোনটা বের করে দেওয়ার জন্য।
সময় গড়াচ্ছিল। ততক্ষণে শত শত মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছেন। কেউ কেউ মোবাইল ফোনে সেই দৃশ্য ভিডিও ও ছবি তুলছিলেন। বাকিরা অবাক তাকিয়ে দেখছিলেন সেই শিক্ষার্থীর সাহসিকতা। কিন্তু শিক্ষার্থী ছিনতাইকারীকে পেটাতে থাকেন। তার পকেট তল্লাশি করে দেখছিলেন তার মোবাইলটা আছে কিনা। নিজের মোবাইল না পেলেও ছিনতাইকারীর একটি ফোন পান। সেই ফোন ঘেঁটে কল করেন ছিনতাইকারীর আরেক সহকারীকে। কৌশলে তাকে দিয়ে ফোন করিয়ে তার সহকারীকে ঘটনাস্থলে আনা হয়। শুরু হয় তাকেও পেঠানো। কিন্তু কারো কাছেই নিজের মোবাইলটি পাননি শিক্ষার্থী। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। পুলিশ এসে দুই ছিনতাইকারীকে আটক করে। পুলিশও ছিনতাইকারীদের কাছে শিক্ষার্থীর মোবাইল আছে কিনা তল্লাশি করেন। না পেয়ে ছিনতাইকারী দু’জনসহ শিক্ষার্থী আর তার সহপাঠীকে তেজগাঁও থানায় নিয়ে যেতে চান। রাজি হচ্ছিলেন না শিক্ষার্থী। উপস্থিত উৎসুক জনতাও থানায় যেতে মানা করছিলেন। সবাই শিক্ষার্থীকে বলছিলেন থানায় গিয়ে জিডি মামলা করে লাভ হবে না। ঘটনাস্থলেই ছিনতাইকারীদের আটকে মোবাইল উদ্ধারের জন্য। নাছোড়বান্দা শিক্ষার্থীও মোবাইল ছাড়া আর কিছুই ভাবছিলেন না। অন্তত আধাঘণ্টা পুলিশের সঙ্গে জেরা করে বলছিলেন। আমি মেয়ে হয়েও হাতেনাতে দু’জন ছিনতাইকারীকে ধরে দিলাম। তবুও আপনারা আমার ফোনটা উদ্ধার করে দিতে পারছেন না। এর মানে পুলিশ ব্যর্থ। উৎসুক জনতাও তার কথায় সায় দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, কাওরান বাজারে প্রতিদিন অর্ধশত মোবাইল ছিনতাই করে ছিনতাইকারীরা পালিয়ে যায়। কেউ কোনো ছিনতাইকারীকে ধরতে পারে না। অথচ একটা মেয়ে দুইটা ছিনতাইকারী ধরে দিলো। তবুও তার ফোন উদ্ধার করে দিতে পারছে না পুলিশ। পরে পুলিশ, শিক্ষার্থী ও ছিনতাইকারীদের থানায় নিয়ে যায়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে পুলিশের পরামর্শে ওই শিক্ষার্থী তেজগাঁও থানায় মামলা করবেন।
তেজগাঁও থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) সারোয়ার আলম খান বলেন, আমরা মামলা নিবো। আটক ছিনতাইকারীদের আদালতে পাঠানো হবে। আর শিক্ষার্থীর মোবাইল উদ্ধারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থীর নাম পারিশা আক্তার (২৫)। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি সদরঘাট এলাকার একটি ছাত্রীনিবাসে থাকেন। গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামে। পারিশা বলেন, সকাল ৯টার দিকে থিসিসের কাজে আমি আমার বন্ধু শাহরিয়ার আলমকে নিয়ে মিরপুর চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম। ফেরার পথে কাওরান বাজারে ঘটনাটি ঘটে। আমি ভাবতেও পারিনি আমার সঙ্গে এমন একটা ঘটনা ঘটে যাবে। আমার মোবাইল হারিয়ে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কারণ মোবাইল আরেকটা কিনতে পারবো কিন্তু মোবাইলের ভেতরে আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট ছিল। যেভাবে হউক আমার মোবাইলটা পেতে হবে। সবাই বলছে আমি সাহসিকতার পুরস্কার পাবো। কিন্তু আমি শুধু আমার মোবাইলটা পেতে চাই। দুইটা ছিনতাইকারীকে ধরে দিলাম, পুলিশ এলো অথচ আমার মোবাইলটা পেলাম না। তিনি বলেন, মোবাইল ছিনতাই হওয়ার পর ছিনতাইকারীকে না পেয়ে আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু চোখের সামনে দিয়ে ছিনতাইকারী যাচ্ছিলো তাই তাকে ধরে মোবাইল ফেরত পাওয়ার আশা করেছিলাম।
এমআই