ডা. মো: হাবিবুল্লাহ তালুকদার:
একদল সুশীল আছেন। তারা নিজেদের অতি উচ্চমার্গের ইন্টেলেকচুয়াল মনে করেন। শিল্প-সংস্কৃতির বোদ্ধা তারা। এবং তারা আশা করেন, সকল শ্রোতা-দর্শক তাদের পছন্দ- অপছন্দের সাথে সহমত জানাবেন। নিজেদের বেড়ে উঠার পরিবেশ, শিক্ষা, রুচির ভিন্নতার কারণে তাদের ভালোলাগা-মন্দলাগা ভিন্নরকম হতে পারবে না। 'কান' যে নাক, চোখের মত শরীরের কোন অঙ্গ না, এটা যাদের জানার কথা না, তারাও কেন রেহানা নুর সিনেমা কিংবা আজমেরি হক বাঁধনের প্রশংসায় মাতে না! কেন ড. মাহফুজুর রহমান প্রতি ঈদে বেসুরো গলায় গান গাইবেন নিজের চ্যানেলে? কেন হিরো আলমের এত জনপ্রিয়তা একটা শ্রেণীর কাছে? কেন ভুল-ভাল ইংরেজি আর দুর্বল উচ্চারণ নিয়ে নিজের সিনেমায় নায়ক-নায়িকা হবেন অনন্ত-বর্ষা? কেন, কেন, কেন?
সমালোচনা আমরা করতেই পারি। কারও কনটেন্টে অশ্লীলতার উপাদান থাকলে তার নিন্দা করতে পারি। ব্যক্তিগতভাবে আমি শিল্পের নামে অশ্লীলতার বিপক্ষে। কিছু চিত্রতারকার প্রকাশ্যে আসা উশৃংখল ও অশালীন কার্যকলাপ আমি অপছন্দ করি। ওয়েবসিরিজের নামে কিছু নির্মাতার চরম অশ্লীলতা নিয়ে টকশোতে কথা বলেছি, লিখেছি। হিরো আলমের বিরোধিতাকারীরা কখনও এসবের বিরোধিতা করেছেন বলে মনে করতে পারছি না।
তাহলে হিরো আলমকে নিয়ে আপনাদের এত জ্বালা কেন? তার একটা বিপুল দর্শক-ভক্তকূল আছে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীর। তারা আনন্দ পেলে তার কন্টেন্ট দেখবেই। আপনাদের অহমিকা কেন এতে আহত হয়? হিরো আলম যে শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করে, তাদেরকেই কি আপনারা আসলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছেন না? কিন্ত এই অশিক্ষিত, নিম্নমার্গের মানুষরা কিন্তু শিক্ষিত সুশীলদের মত দেশের ততটা ক্ষতি করে না। বালিশকান্ডসহ বিশাল বিশাল দুর্নীতি কিন্তু হিরো আলম কিংবা তার দর্শকশ্রেনীর কেউ করে না। করে আর্টফিল্মের দর্শকশ্রেণিভূক্ত শিক্ষিত সুশীল মানুষরা। তবে হিরো আলমের কনটেন্টের অশ্লীল ভাষা কিংবা বডি ল্যাঙ্গুয়েজকে কিন্তু আমি সমর্থন করছি না। আবার ওর কনটেন্টের অশ্লীলতার উপাদানের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার, তাদের দ্বিচারিতাও মেনে নিতে পারি না। সেদিন দেখলাম, হিরো আলমের কনটেন্ট অন্তর্জাল থেকে সরিয়ে দিতে একজন মামলা করেছেন। এটা নাকি সমাজকে কলুষিত করছে। জাত-কূলহীন বেচারা হিরো আলমের কাছ থেকে পুলিশ মুচলেকা আদায়ের মতো নজিরবিহীন কান্ড ঘটালো। পুলিশের পোষাক পরার কথা না হয় বুঝলাম। রবীন্দ্র- নজরুল সঙ্গীত গাইতে কারও নিষেধাজ্ঞা দেয়ার বিধানের কথা এই প্রথম জানলাম। হিরো আলমের অশ্লীলতার বিচার হয়। অথচ লাস্যময়ী নায়িকার এত কীর্তিকলাপ, ভি-চিহ্ন, আর 'ডট মি বিচ' জাতীয় অমিয় বানী ও অঙ্গভঙ্গি সুশীলদের কাছে বড় কাব্যিক মনে হয়!
মাহফুজুর রহমান তার নিজের চ্যানেলে গান করেন। গলায় সুর নেই। হাসি পায় অনেকের। তার সংগীতচর্চা নিয়ে একটু নির্মল হাস্যরসের চর্চ্চা হতেই পারে। কিন্তু টীকা-টিপ্পনির মাত্রা অনেক ক্ষেত্রে সীমা ছাড়িয়ে যায়। তখন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে। ব্যবসায়ী মাহফুজুর রহমান স্যাটেলাইট টিভি এনেছেন শুরুর দিকে। অনেক শিল্পী সেখানে পারফর্ম করার সুযোগ পেয়েছেন। এখনকার মত এত এত চ্যানেল তো তখন ছিলো না। তো গানের প্রতি ভালোবাসা থেকে নিজের চ্যানেলে বছরে দু-একবার যদি নিজেকে শিল্পী হিসেবে জাহির করেন, এটা তার নিজের রুচির উপর ছেড়ে দেই না কেন? আমার ভালো লাগে না, আমি দেখবো না। কিন্তু তাকে নিয়ে নির্মম ট্রল করার উদ্দেশ্যে সেই গান দেখা ও শোনার এই মনোবৃত্তির মধ্যে আমি বিকৃতি দেখি।
অনন্ত জলিল একজন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী। কোভিড অতিমারীর মধ্যেও আমাদের অর্থনীতির জীবনরেখা চালু রাখা পোষাকশিল্পের বড়সড় প্রতিষ্ঠান চালান। মালিক হিসেবে মানবিক গুণাবলির কথাও শোনা যায়। সফল ব্যবসায়ী অনন্ত সিনেমা বানানো শুরু করেছেন নায়ক হওয়ার জন্য। নায়িকা বর্ষাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। এবং কোন স্ক্যান্ডাল ছাড়াই অনেকগুলো বছর দুজনে সংসার করছেন। ব্যবসার ফাঁকে স্বামী-স্ত্রী নায়ক-নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করছেন। ভুলভাল ইংরেজি ডায়ালগ দিচ্ছেন। উচ্চারণের ভয়াবহ সমস্যা। গল্প, নির্মাণ, কারিগরি দিক দুর্বল। তাই হাসাহাসি হতেই পারে। কিন্তু দিন দ্য ডে নিয়ে এবারও সুশীল দর্শকদের ট্রল মাত্রাছাড়া। যদিও আমি এবার ছবির কারিগরি দিক নিয়ে বেশ কিছু পজিটিভ রিভিউ দেখলাম।
এবার ঈদে দিন দ্যা ডে সহ তিনটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। এবং যতদূর জানলাম তিনটে ছবিই ভালো ব্যবসা করেছে। প্রচারণার মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। কিন্তু এবার প্রচারণার মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চোখে লেগেছে। চলচ্চিত্রের শিল্পীরা বিভক্ত হয়েেছেন। পক্ষ নিয়েছেন। দীর্ঘদিনের সংসারী জুটি অনন্ত- বর্ষাকে অনেকটা নিঃসঙ্গ মনে হয়েছে শিল্পীসমাজের মধ্যে। সবচেয়ে বড় কথা, সুশীল শ্রেণি এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে জড়িয়ে গেছেন। তারা সুশীল বাক্যবাণে অনন্ত-বর্ষাকে ধুয়ে দিচ্ছেন। চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে পক্ষ নিয়েছেন বুঝে কিংবা না বুঝে।
সুশীল বোদ্ধাদের এত তৎপরতা খুব একটা গায়ে মাখছেন না দর্শকরা। তারা নিজেদের রুচিমত নিজেদের বিনোদন খুঁজে নিচ্ছেন। বিনোদিত হচ্ছেন, কারণ সবাই তো আর ফিল্ম ফেস্টিভালের খবর রাখেন না। ভালোবাসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখছেন নিজেদের পছন্দের তারকাদের।
কাউকে কাউকে বলতে শুনলাম, অনন্ত-বর্ষা ছবি বানাক। শুধু নিজেরা অভিনয় না করুক। দারুণ তো! অনন্ত জলিল প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী চলচ্চিত্রের বাইরে। তিনি হয়তো সিনেমা বানান সিনেমার নায়ক হওয়ার বাসনা থেকে। বর্ষাকে নায়িকা বানানো হয়তো প্রেমিকা ও স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা থেকে। আপনার পছন্দ না হলে দেখবেন না। মাহফুজুর রহমানের গান শুনবেন না। হিরো আলম তো আপনাদের কাছে রীতিমত অচ্ছুত সমাজের মানুষ। কিন্তু ওদের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ যেন বিকৃতির পর্যায়ে না যায়। প্রতিটা মানুষের কিন্তু সম্মান পাওয়ার কথা।
জানি এই লেখা পড়ে আমার প্রতিও অনেকে বিদ্রূপ-বাণ ছুড়বেন। কিন্তু আমি বিশ্বাসের জায়গা থেকে বলছি। মাহফুজুর রহমান, হিরো আলম, অনন্ত-বর্ষার মধ্যে আমি একটা সংগ্রামী রূপ দেখতে পাই। এত বিদ্রূপ অপমানের মধ্যেও তারা হাল না ছেড়ে শিল্পের প্রতি তাদের আগ্রহ ধরে রেখেছেন। প্রতিভার ঘাটতি আছে। আবার ভালোবাসাটাও আছে।