কমল জোহা খান : জনকণ্ঠ, এককালের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা। ঘড়ির কাঁটা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাটি আর সেই ধারাবাহিকতায় থাকতে পারেনি। এজন্য নানা কারণ থাকতে পারে। পত্রিকাটির কর্তাব্যক্তিরা এর কারণ ভালো জানবেন।
আমার মতো অনেকেই প্রাপ্য পাওনা না পেয়ে জনকণ্ঠের চাকরি ছেড়েছেন। এই গেল সপ্তাহেও রাস্তায় নেমে বকেয়া বেতন, চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদ জানিয়েছেন জনকণ্ঠের বহু সংবাদকর্মী। আমাদের বাংলাদেশে সংবাদপত্রে যুগ যুগ ধরে এমনি প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেই চলেছে। গণমাধ্যম কর্মীরা কখনো রাস্তায় নামছেন, কখনো মিছিল, সমাবেশ করছেন।
যাহোক, নিচে দুটি ছবি রয়েছে। একটিতে আমার বাবা দৈনিক সংবাদ কার্যালয়ে টেলিফোন রিসিভার হাতে কথা বলছেন। তাঁর পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি সাংবাদিক ছিলেন। পরে পেশা ছেড়ে বিরাট শিল্পপতি হয়েছিলেন।
আরেকটি ছবিতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে হাতে কালো ফিতা জড়িয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করতে দেখা যাচ্ছে। কর্মসূচিটি দৈনিক ইত্তেফাকে চলছিল। দাবি কি ছিল সেটি জানা নেই। তবে এই কর্মসূচিতে অন্য অনেকের মধ্যে আমার বাবা মোহাম্মদ তোহা খানও ছিলেন। তাঁর কাছ যতটুকু জেনেছি, তাহলো মালিকপক্ষের কোন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এই কর্মসূচি ছিল।
স্বাধীনতার পর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্যে ইত্তেফাক ছেড়ে দৈনিক সংবাদে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন আমার বাবা। সেখানেও বেতন সময়মতো পাওয়া যেত না। তাই ধারদেনা করতে হতো তাঁকে। তাছাড়া সংবাদে চাকরিচ্যুতির ঘটনা প্রায়ই ঘটত। একবার বেতনের দাবিতে মাসখানেক সংবাদে আন্দোলন চলেছিল। সেই আমলে সেরা, জনপ্রিয় ও অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা হওয়ার পরও দৈনিক সংবাদ এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটত সেটিও হয়ত তাদের কর্তাব্যক্তিরা ভালো করে জানতেন।
অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই দৈনিক সংবাদ ছাড়তে বাধ্য হন আমার বাবা।
তবে সংবাদিক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। যদিও বাবার প্রচণ্ড নিষেধ ছিল এই পেশা বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে। তিনি বলেছিলেন, কাজ শুরু করলে বুঝতে পারবে।
আর্থিক অনটনে, চিকিৎসার অভাবে আমার বাবা মোহাম্মদ তোহা খান ৬৮ বছর বয়সে আজ থেকে ২৫ বছর আগে ১৯৯৬ সালে মারা যান। জীবদ্দশায় তিনিও সংবাদ থেকে তাঁর পাওনার সবটুকু পাননি।
নাম পরিবর্তন করে একের পর এক দৈনিক পত্রিকা আসছে। ভবিষ্যতেও আসবে। কিন্তু সেগুলোর চরিত্র একই রকমের থাকছে এবং থাকবে।
খুব কাছ থেকে দেখেছি, কোন কোন পত্রিকায় দিনরাত কাজ করেও সর্বোচ্চ পদধারীর মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় কিভাবে। অসুস্থ হয়ে কাজ করলেও তাঁর কটূক্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়নি।
এখন তো সংবাদকর্মীরা বেতন ভাতা তো পাচ্ছেন না। তাদের জন্য আগামীতে ওয়েজবোর্ড নামের বেতন কাঠামোও হয়ত মিলবে না। আর আগের মতো মর্যাদা কবেই হারিয়ে গেছে।
এখন বুঝতে পারছি, বাবা কেন সাংবাদিক হতে নিষেধ করেছিলেন। তাই চার পুরুষের পেশা সাংবাদিকতা হলেও আমার পরবর্তী প্রজন্মের কেউ আর এই পেশায় নাম লেখাবে না।
লেখক : সাংবাদিক