শাহিনুর ইসলাম প্রান্ত, লালমনিরহাট প্রতিনিধি:
এক হাজার টাকায় মাসিক সুদ ৬শত টাকা। সুদখোর মহাজনের চাপে সপরিবারে নিখোঁজের ৬বছরেও বাড়ি ফিরেনি লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার কৃষক ব্রোজেন্দ্রনাথ ব্রোজেন(৫৩)।
ব্রোজেন্দ্রনাথ ব্রোজেন উপজেলার পলাশী ইউনিয়নের মহিষাশ্বহর গ্রামের জামতলা এলাকার মৃত সুরেন্দ্রনাথের ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, ব্রোজেন্দ্রনাথ কৃষি কাজ করে এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে সুখেই ছিলেন। ৭/৮ বছর আগে এক বন্যায় গ্রামে ধান ক্ষেত নষ্ট হলে বিপাকে পড়ে কৃষকরা। সংসার চালাতে চরাসুদে স্থানীয় রাজমোহাম্মদের ছেলে চিহ্ণিত দাদন ব্যবসায়ী জাহেদুল ইসলামের নিকট থেকে কিছু টাকা গ্রহন করেন ব্রোজেন। তবে এ ঋনের খবর তার পরিবার ছাড়া কেউ জানত না। প্রায় সময় সেই সুদের টাকার জন্য সুদখোর মহাজন দলবল নিয়ে ওই বাড়িতে আসত বলে দাবি করেন স্থানীয়রা।
এরপর ২০১৬ সালে হঠাৎ এক রাতে সপরিবারে বাড়ি ছাড়া হন ব্রোজেন। বৃদ্ধ বাবা সুরেন্দ্রনাথ প্রতিটি রাত ছেলের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। ব্রোজেন সপরিবারে নিরুদ্দেশের খবর সুদখোর মহাজনের কাছে পৌছলে দাদন ব্যবসায়ী জাহেদুল দলবল নিয়ে ব্রোজেনের বৃদ্ধ বাবার কাছে ব্রোজেনের ১৩ লাখ টাকা ঋন পরিশোধের জন্য চাপ দেন। দাদন ব্যবসায়ী জাহেদুল তার লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে বৈঠক করে সাড়ে ৪লাখ টাকা চুড়ান্ত করেন।
সেই টাকা পরিশোধের জন্য ব্রোজেনের বাবাকে চাপ দেন। টাকা না থাকায় ব্রোজেনের বাবা বাধ্য হয়ে চাষাবাদের ৫৪ শতাংশ জমি সুদখোর মহাজন জাহেদুলের কাছে বিক্রি করেন। কিন্তু কৌশলী জাহেদুল তা অন্যের কাছে বিক্রি করে রেজিস্ট্রি করে নেন। জমি ৫৪ শতাংশ বিক্রি করেও ছেলে এবং তার পরিবারের খোঁজ না পেয়ে শোকে গেল দুই বছর আগে মারা যান সুরুন্দ্রনাথ। দীর্ঘ ৬ বছরেও কোন খোঁজ নেই ব্রোজেন্দ্রনাথের পরিবারের।
ব্রোজেনের ভাই গজেন্দ্রনাথ বলেন, ব্রোজেন সম্ভবত ৫০ হাজার টাকা ঋন করতে পারে। যা সুদে আসলে ১৩ লাখ দাবি করে জাহেদুল। আমরা জমি বিক্রি করে সাড়ে ৪ লাখে দেনা পরিশোধ করেছি। তবে বৈঠকে দেখানো স্ট্যাম্পটি আজও ফেরৎ দেয়নি। নিখোঁজ ভাইয়ের কোন সন্ধানও মেলেনি। তার সন্ধানে আইনগত ব্যবস্থা নেননি কেন? -এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তাদের অনেক ক্ষমতা ও টাকা আছে। প্রতিবাদ করলেও আমরাও থাকতে পারব না।তাই কিছু করিনি।
শুধু ব্রোজেন্দ্রনাথই নয়, জাহেদুলের সুদের চক্রে পড়ে নিস্ব হয়েছে স্থানীয় একরামুল হকের পরিবার। তিনিও হাজারে দৈনিক ১৫ টাকা সুদে দাদন ব্যবসায়ী জাহেদুলের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা গ্রহন করেন। সেই টাকার সুদই দিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ।এরপরও ১৩ লাখ দাবি করেন সুদখোর মহাজন। সুদের টাকার জন্য দাদনের লাঠিয়াল বাহিনী প্রায় বাড়িতে এসে হামলা চালাত। এক পর্যয়ে নিস্ব একরামুল হক বাড়ির উঠানের জমিটুকু বিক্রি করে সাড়ে ৫লাখ টাকা দিয়ে আপোষ করেন। কিন্তু বাকী ৭ লাখ টাকা দেখা হলেই দাবি করেন সুদখোর মহাজান।
গেল মাসে সেই ৭ লাখ টাকার জন্য একরামুলের স্ত্রীকে বাড়ির পাশে পেয়ে আটক করেন জাহেদুল। গালমন্দ ও মারপিট করে শ্লীলতাহানী করেন। স্থানীয়রা ওই গৃহবধূকে দাদন ব্যবসায়ীর কবল থেকে উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় ওইদিনই গৃহবধূ আদিতমারী থানায় লিখিত অভিযোগ করলেও গত এক মাসেও কোন ব্যবস্থা নেই নি পুলিশ।
তবে ওই অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা আদিতমারী থানার উপ পরিদর্শক(এসআই) ওয়ালিউর রহমান বলেন, নারীকে শ্লীলতাহানীর ঘটনায় মামলা দায়ের করা যায় মর্মে ওসি স্যারকে একাধিকবার বলেছি। তিনি মামলা না নিলে আমার কি করার?।
এতেই শেষ নয়, একই গ্রামের স্কুল শিক্ষক আনিচুর রহমান মাত্র ৯০ হাজার টাকা নিয়ে সুদ দিয়েছে ৭ লাখ। এরপরও আসল ৯০ হাজার টাকার জন্য প্রায় দিন চাপ দেন দাদন ব্যবসায়ী জাহেদুল ইসলাম।
জাহেদুল ইসলামসহ ওই গ্রামে দাদনের ব্যবসা করেন মতিয়ার রহমান ও আতিয়ার রহমান নামে দুই ভাই। তাদের একজন মতিয়ার রহমান দেড় মাস আগে সুদের দেড় লাখ টাকার জন্য স্কুল শিক্ষক আনিচুরকে স্থানীয় হাটে আটক করে কোমড়ে গামছা বেঁধে আদিতমারী থানায় নিয়ে যায়। সেখানে ওসি মোক্তারুল ইসলামের উপস্থিতিতে ৩মাস সময়ে মুক্তি মিলে স্কুল শিক্ষকের। সেদিন থানায় সিদ্ধান্ত হয় তিন মাস পরে মাসিক ৫/৭ হাজার টাকা কিস্তিতে উক্ত সুদের টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানান স্কুল শিক্ষক আনিচুরের স্ত্রী।
শুধু আনিচুর, ব্রোজেন বা একরামুলই নয়।দাদন ব্যবসায়ীদের চক্রে নিস্ব মহিষাশ্বহর গ্রামটি। একদিকে দ্রব্যমুলের ঊদ্ধগতি অন্যদিকে নদীর পানির কারনে অনাবাদি গ্রামটির সকল ফসলি জমি। চরাসুদের বা সুদখোরদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করেও সুফল পায়নি স্থানীয়রা। তাদের লাঠিয়াল বাহিনী ছাড়াও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে দারুন সখ্যতা রয়েছে বলে দাবি স্থানীয় ভুক্তভোগীদের। তাদের সখ্যতার কারনে অভিযোগ দিলেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি থানা পুলিশ। উল্টো দাদন ব্যবসায়ীদের জাল স্ট্যাম্প তৈরী করে মামলা নিয়ে হয়রানী করেন।
থানায় অভিযোগকারী বাদি একরামুলের স্ত্রী জান্নাতুল আখি বলেন, সুদ দেয়ার পরও জমি বিক্রি করে বৈঠক করে ৫লাখ টাকা জাহেদুলকে টাকা বুঝিয়ে দিয়েছি। এরপরও আরও টাকা দাবি করে।তা না দেয়ায় আমাকে আটক করে মারপিট করেছে। এ ঘটনায় ওই দিনই থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।কিন্তু এক মাস হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। প্রথম দিকে আপোষ করে দিতে চাইলেও ১৫/২০ দিন ধরে পুলিশ কিছু বলে না। শুনেছি, বর্তমান ওসি'র নানার বাড়ি পাশের গ্রামে। সেই সুত্রে দাদন ব্যবসায়ী জাহেদুলের দুর সম্পর্কের আত্নীয় হন বর্তমান ওসি।
আদিতমারী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি-তদন্ত) রফিকুল ইসলাম বলেন, দাদন ব্যবসার কোন বৈধতা নেই। সেদিক থেকে তাদের সাপোর্ট দেয়াও সুযোগ নেই। একমাসেও গৃহবধুর অভিযোগি আমলে না নেয়ার বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
এমআই