মনির হোসেন:
আটলান্টিকের ওপারের একটি দেশের খেলা নিয়ে বাংলাদেশে এত মাতামাতি কেন? এদেশের মানুষের কোনো কাজ নেই? প্রশ্নগুলো খুব স্বাভাবিক। কিন্তু দীর্ঘকাল থেকেই আর্জেন্টিনা নির্যাতিত একটি দেশ। ব্রিটিশরা একচেটিয়াভাবে শোষণ ও নির্যাতন চালিয়েছে। জুলুম করেছে ইউরোপের অন্য দেশও। তুলনামূলকভাবে গরীব দেশটি ফুটবলে লাথি দিয়ে এসব অন্যায় নির্যাতন ও জুলুমের জবাব দিয়েছে। খেলার মাঠেও বার বার অবিচারের শিকার হয়েছে। তবে যতই অবিচারের শিকার হয়েছে, তত বেশি মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে। মহাতারকা দিয়েগো ম্যারাডোনা তার অন্যতম উদাহরণ। এরপর আগমন ঘটে লিওলেন মেসির।
তবে শুধু নির্যাতিতই নয়, সব সময়ই নির্যাতিতদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে মেসিরা। সর্বশেষ ফিলিস্তিনে হামলার প্রতিবাদে ২০১৭ সালে ইসরলাইলের সঙ্গে আয়োজন করা বিশাল ব্যয়বহুল প্রীতি ম্যাচ বাতিল করেছে। এর মাধ্যমে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে থাকা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জয় করেছে আর্জেন্টিনা। আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো দেশ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে সাহস পায়নি। ওই সময়ে নিজের আয়ের কিছু অর্থ ফিলিস্তিনি শিশুদের দিয়েছে লিওনেল মেসি। ফলে খেলা নয়, আমার কাছে মনে হয় ফুটবলে দেওয়া মেসিদের প্রতিটি লাথি শোষকদের কলিজায় আঘাত।
২৭ লাখ ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের মধ্যম আয়ের দেশ আর্জেন্টিনা। আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে ১৯গুন বড় দেশটিতে ৪ কোটি মানুষের বসবাস। মাথা পিছু আয় ১০ হাজার ৬৬৭ ডলার। কিন্তু ফুটবলেই এর পরিচয়।
১৯৭৮ এবং ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ জিতেছে আর্জেন্টিনা। এরপর রানার আপ হয়েছে আরও তিনবার। ২০১৪ সালে সর্বশেষ রানার্স আপ। এছাড়া কোপা আমেরিকাসহ অন্যান্য আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হলেও দলীয়ভাবে দীর্ঘদিন বিশ্বকাপে উল্লেখযোগ্য কোনো সফলতা আসেনি। তবে এরপরও ভক্তের সংখ্যা এতটুকু কমেনি। বরং নতুন প্রজন্মও মনে প্রানে আর্জেন্টিনার সাপোর্ট করছে। ম্যারাডোনা মহাতারকা হলেও লিওনেল মেসি সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি আজ সেরাদের সেরা। শুধু পায়ের জাদু বা নান্দনিক ফুটবল নয়, এ পর্যন্ত অর্জন করা রেকর্ড, খেলার মাঠে ভদ্রতা, বিনয়, নম্রতা, উদারতা, নেতৃত্ব, পরিচ্ছন্ন লাইফ স্টাইল ও নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাড়াঁনোসহ সব মিলিয়ে একজন মেসির জন্য পৃথিবীকে বহু বছর অপেক্ষা করতে হবে।
আটগজ দুরত্বের দুটি গোলবারের মধ্যদিয়ে বল জালে স্পর্শ করাতে পারলেই একটি দল শ্রেষ্ঠ হয়ে যায় না। এভাবে একজন মানুষকে সেরা খেলোয়ার হিসেবে বিবেচনা করাটা পুরোপুরি সুবিচার নয়। কোটি কোটি মানুষের আবেগ, উচ্ছাস, ভালোবাসা এবং হৃদয়ে স্থান পাওয়া তার চেয়ে অনেক বড়। আর এর সবকিছুই রয়েছে লিওনেল মেসির। যে দলটির বিজয়ে কোটি কোটি মানুষের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়, যে দলটির পরাজয়, কোটি মানুষের চোখ ভিজিয়ে দেয়, সে দলের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য কাপ জরুরি নয়। এটি একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এই আনুষ্ঠানিকতাও দক্ষতার সঙ্গে শেষ করেছে মেসিরা। ম্যারাডোনার উত্তরসূরীদের কাপ জেতা, নিশ্চয়ই বিশ্বকাপের সম্মান বহুগুন বাড়িয়েছে। আর ১৯৯০ সালে ম্যারাডোনার চোখের পানির যোগ্য জবাবটাও জরুরি ছিল। অবিরাম ভালোবাসা প্রিয় তারকা লিওনেল মেসি। আজ তুমি হেরে গেলে তুমি নয়, হেরে যেত ফুটবল।
লেখক : মনির হোসেন, সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক যুগান্তর।