বুধবার, ডিসেম্বর ২৮, ২০২২
সময় জার্নাল ডেস্ক:
আসলে সুষম সমাজ কী, কেন? এর জবাবে অর্থনীতিবিদ প্রফেসর পারভেজ বলেন, এটা একটা ন্যায়ভিতিক সমাজ ব্যবস্থা। যা মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, ন্যায়বিচার, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার প্রয়োজন পূরণের নিমিত্তে সমাজকে ঢেলে সাজায় কিন্তু তা পুরণের অঙ্গীকার করেনা। সুষম সমাজ প্রতি পরিবারে জাতীয় আয় পৌঁছানোর অঙ্গীকার করে, যাতে সমাজের প্রতিটি পরিবারের সকল সদস্য মৌলিক চাহিদা যথা- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার প্রয়োজন নিজেরাই পূরণ করতে পারে। মূলতঃ আকাশ-পাতাল বৈষম্যময় নিষ্ঠুর সমাজের বিপরীতে একটি মানবিক সমাজের কথাই বলতে চান গরীববান্ধব অর্থনীতিবিদ প্রফেসর পারভেজ। যে সমাজে বেকারত্ব থাকবে না। ক্ষুধা দারিদ্র থাকবে না। শোষণ-বঞ্চণা থাকবে না। থাকবেনা লুটেরা ধনীদের হুংকার বা অহংকার। যে সমাজ হবে শান্তিময় ও স্বস্তিময়। যে সমাজে মাদক এর বিরুদ্ধে চলবে অবিরাম যুদ্ধ। যে দেশের প্রশাসন-আইন-আদালত অর্থনীতি হবে জনবান্ধব। শৃঙ্খলা থাকবে দৈনন্দিন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বত্রে।
প্রফেসর পারভেজের মতে সুষম সমাজে সমাজতান্ত্রিক সমাজের মতো মানুষের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। আবার অন্ধ পুঁজিবাদী সমাজের মতো সীমাহীন শোষনের লাইসেন্সও কেউ পাবে না। আসলে গ্রহণযোগ্য সীমিত বৈষম্য মেনে একটি মানবিক সমাজের কথাই তিনি বলতে চাচ্ছেন। তিনি বলেছেন সুষম সমাজের জন্য যে কোন সমাজের মানুষের প্রস্তুতি প্রয়োজন। আমাদের সমাজ একটি সুষম সমাজ নির্মাণেরে জন্য প্রস্তুত ছিলো না। প্রয়োজন ও অনুভব করেনি। মোটা চাল, মোটা কাপড় ছিলো তাদের একমাত্র চাহিদা। কিন্তু বর্তমান ভারসাম্যহীন বিশ্বে, ভারসাম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কুপ্রভাবগ্রস্থ দেশের অর্থনীতি সংকটে, মানুষ কঠিন জগদ্দল পাথরের চাপে। এমন একটি সময় উপস্থিত যখন ঘরে ঘরে মানুষ আজ ন্যায় ভিত্তিক সমাজ চায় - চায় সুষম সমাজ ব্যবস্থা। এছাড়া আর কি কারণে তিনি এই সুষম সমাজের চিন্তা চেতনায় নিমগ্ন হলেন তা তাঁর কাছেই শোনা যাক।
প্রফেসর পারভেজ বলেন, বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন ছিলো পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যেকার বৈষম্য দূর করে অর্থনৈতিক মুক্তির। পরবর্তী- তে যা স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে জন্ম নেয় স্বাধীন রাষ্ট্র-বাংলাদেশ। আমরা রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন হয়েছি সেই ১৯৭১ সালে, প্রায় ৫১ বৎসর আগে। তবুও গরীবের- মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক মুক্তি এখনো আসেনি। সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী ২ কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার উপরে উঠলেও বাস্তবে ধর্মীরা আরো ধনী হয়েছে, অর্থ সম্পদের হিমালয়ের চূড়ায় এখন তাদের অবস্থান। বৈষম্যের দগদগে ঘা এখনও সমাজের সর্বাঙ্গে বিরাজ করছে, যা আমরা দেখেও দেখছিনা। আজও অর্থনৈতিক মুক্তি জোটেনি দেশের ৬০ ভাগ মানুষের কপালে। মানুষের বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতা আরও কঠিন থেকে কঠিনতরো হয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্রীয় সম্পদের ভাগাভাগি, ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুষম সুযোগ, ভাল চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ, ভাল আবাসনের সুযোগ, ব্যাংকে ঋণ পাওয়ার সুষম সুযোগ অনুপস্থিত, সব ক্ষেত্রেই বৈষম্য। বিত্তশালী ২ হাজার পরিবারের মানুষ আর নিম্ন আয়ের কোটি কোটি মানুষের অবস্থান আজকে যেন ভিন্ন ভিন্ন গ্রহে। গার্মেন্টসসহ অনেক কল-কারখানায় ৬০০০-৮০০০ টাকা বেতনের মানুষগুলি আর ওয়েস্টিন, রেডিসন ব্লু-তে ৬০০০-৭৫০০ টাকার প্লেটে ইফতার করা মানুষগুলি একই গ্রহে, একই সমাজে বসবাস করে- যা খালি চোখে দেখতেও খটকা লাগে। মানুষে মানুষে শ্রেণী পার্থক্য ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। তাই যখন একটা বিশেষ শ্রেণীর মানুষরা সামান্য সর্দি-কাশির চিকিৎসা বা চেক-আপের জন্য বিদেশে যায় তখন অন্য শ্রেণির মানুষরা দেশে মানুষ মারার, পকেট মারার হাসপাতাল-ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসা ও ভুয়া ডাক্তারের হাতে মরছে ! যা সত্যিকারের মানব-সভ্যতা ও অধিকারের জন্য লজ্জাজনক। যেখানে কোটি কোটি মানুষ দিনের তিনবেলার খাবারের জন্য ২০০ টাকা জোগাড় করতে হিমসিম খাচ্ছে, সেখানে বিএমড-ব্লিউ, মার্সিডিজ, লেক্সাস-এর মালিকরা ৬৫০০ থেকে ৮৫০০ (ড্রিংক সহ) টাকার বাফেট খাওয়া জীবন দেখে বলে দেয়া যায় যে, এই দুই শ্রেণীর মানুষগুলোর মধ্যে দূরত্ব-দ্বন্দ ক্রমবর্ধমান। যা একটি ভঙ্গুর অসম সমাজব্যবস্থাকে নির্দেশ করে । দেশে ২৯-৩২ লক্ষ শিক্ষিত বেকারসহ অশিক্ষিত, অদক্ষ বেকার বাড়ছে তো বাড়ছেই। এতে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উগ্রবাদী তরুণ যুবক-যুবতীর সাপ্লাই বৃদ্ধি পাচ্ছে।এর ফলে সমাজে একটি হতাশাগ্রস্থ জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। অথচ দেশের শাষকশ্রেণী ও এমনকি বিদেশীরাও জঙ্গী উত্থানের আশংকার কথা বলছেন। বেকার জনশক্তির একটা অংশ নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে।নতুন প্রজন্মকে হতাশা গ্রাস করায় তারা বিপথগামী হয়ে অনৈতিক ও অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে।কেউ কেউ উগ্রবাদী হয়ে উঠছে।
সামাজিক ন্যায়বিচারের নামে সরকারী-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দূর্নীতি-ঘুষ বেতন ভাতার সুবিধার ক্ষেত্রে হরিলুট চলছে।
মানব অধিকার, নারীঅধিকার নিয়ে এন.জি.ও দের ব্যবসা-বাণিজ্য ভাল চলছে। কিন্তু বাড়ছে গুম, খুন, হত্যা ও রক্তের হোলি খেলা ! ভাদ্র মাসে কুকুর পাগল হওয়ার গল্প আমরা জানি কিন্তু এখন জানছি সারা বৎসর পাগল হয়ে থাকা নরাধম মানুষগুলোর কথা। দানবরূপী এই অমানুষগুলো আর যন্ত্র-দানবগুলো পিষে মারছে নিরিহ মানুষকে। এ এক ভয়াবহ বাস্তবতা।সোনার এই দেশ ছেড়ে কর্মের আশায়, ভালোভাবে বাঁচার আশায় বিদেশে পালাতে গিয়ে সাগরে ডুবে, গুলিতে মরছে পলায়নপর শত শত মানুষ।
শিক্ষার গুণগত মান নতজানু। জনশক্তির দক্ষতা ক্রমহ্রাসমান। দেশের স্বল্প শিক্ষিত, শিক্ষিত যুবসমাজ প্রযুক্তি শিক্ষাহীন হয়ে পরছে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য ট্রেড-কোর্স বা ডিপ্লোমা এর মাধ্যমে দক্ষ কর্মীবাহিনী তৈরীর কোন প্রচেষ্টাও নেই। কেরানী তৈরির শিক্ষায় তরুণদের আজ অর্ধশিক্ষিত করে তুলছে দেশের সরকারী-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিদেশের চাকরী বাজারের জন্য তারা যেমন অযোগ্য তেমনি দেশের চাকরীর বাজারের চাহিদাও পূরণ করতে পারছে না এই লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে দেশের ভুয়া শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা।
চারিদিকে চিকিৎসা খাতেও চলছে লাগামহীন প্রতারণা। নকল ওষুধ, ভুয়া টেকনিশিয়ান-চিকিৎসক নানান প্রতারণার ফাঁদে আজ চিকিৎসা সেবা। ভেজাল শুধু ভেজাল ! চারপাশে দারিদ্র্য ও দরিদ্র-সম মানুষগুলির আশ্রয়ের কোন স্থান নাই। তাই সমাধান খুঁজে বের করে সামনে আগানো ছাড়া জাতির সামনে এখন আর কোন পথ খোলা নেই। সেই পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে এক নতুন সমাজ তৈরীর দৃঢ় প্রত্যয়ে। ২০২৩ সালে বাসায় বসে ঝিমুনীর সময় নাই। উঠে দাঁড়াতে হবে হত দরিদ্র - মধ্যবিত্ত - বেকার সমাজের প্রত্যেককে, রাজনীতির নতুন ধারা - নতুন মান প্রতিষ্টার জন্য লড়াই করতে হবে। তবেই ২০২৩ সালে সুষম সমাজ নির্মাণের ফাউন্ডেশান প্রোথিত হবে। আপনার মনজগতে সুপ্ত সেই রাষ্ট্রব্যবস্থ্ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে প্রফেসর পারভেজের সাধনার সুষম সমাজ।
এমআই