সর্বশেষ সংবাদ
সময় জার্নাল প্রতিনিধি/সিরাজাম মুনিরা:
অধ্যাপক পারভেজের সুষম সমাজ বিনির্মাণ বইয়ের “ব্যাংকিং খাতকে ঢেলে সাজানো” নামক একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তুলে ধরা হলো। বর্তমান বাংলাদেশে জনসংখ্যা ১৬ কোটির অধিক এবং ছোটো-বড় সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা হলো মাত্র ৫৭ টি। দেশে যে পরিমান জনসংখ্যা রয়েছে তার তুলনায় ৫৭ টি ব্যাংক কি আপনাদের কাছে যথেষ্ট বলে মনে হয়? আপনার কিংবা আমার কাছে মনে হলেও একজন অর্থনীতিবীদ এবং একজন গবেষক হিসেবে অধ্যাপক পারভেজ তা মনে করেন না।
এইতো কিছু কাল আগে ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক হিসাব চালু করার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো, তা ছিলো মূলত কৃষকদের জন্য। গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে প্রায় ১ কোটি ৫৩ লক্ষ ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছিলো। এ সব হিসাবের বিপরীতে আদায় করা হয়েছে প্রায় ১৪ শত কোটি টাকা। কিন্তু এই হিসাবধারী গরিব, মজদুর ও অসহায় কৃষকদেরকে মাত্র ৫৩ কোটি টাকা লোন দেয়া হয়েছে। যে দেড় কোটি লোক ১০ টাকা দিয়ে একাউন্ট খুলেছে তারা Dorment হয়ে আছে। তাঁরা সহ প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়েছে। তাই এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য আরো ব্যাংক গড়ে তোলা দরকার।অপ-ব্যবস্থাপনায় ডুবন্ত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মকর্তাগণ বলে থাকেন ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চলতে তারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন।এই ধারনা ভুল, তাদের ব্যাংকিং ও প্রতিযোগিতামূলক বিনিয়োগ ব্যবস্থা কোনোটার সম্পর্কে জ্ঞান নেই। বাংলাদেশে এখনও প্রায় চার কোটি মানুষ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে আছেন অর্থাৎ তাদের কোনো একাউন্ট নেই। সেক্টর ভিত্তিক বিশেষায়িত ব্যাংক গঠন করতে পারলে সকল মানুষকে ব্যাংকিকের আওতায় আনা সম্ভব।
কিন্তু সতর্কর্তার বিষয় হলো অতীতের মত আর নতুন কোন Schedule Commercial ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা নেই। এখন যা দরকার তা হলো সেক্টার ভিত্তিক বিশেষায়িত ব্যাংক। লেখক মনে করেন যে, চলমান ব্যাংকিং কার্যক্রমে যা হচ্ছে তা হলো, কোটি কোটি গরিব, দারিদ্র্য, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা এনে তা দেয়া হচ্ছে বা বিনিয়োগ করা হচ্ছে কয়েক শত পরিবারের মাঝে। লোন হিসেবে বিনিয়োগের অর্থ যদি দারিদ্র নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও নারী উদ্যোক্তাদের হাতে যেত উন্নয়ন চারগুণ বৃদ্ধি পেতো। বর্তমান ব্যবস্থায় দেশের উন্নয়ন দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। গরিব বান্ধব অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হলে দেশ এতো দিনে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতো এবং ২০৪১ কেন ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়াতে পারতো।
সেক্টর ভিত্তিক বিশেষায়িত ব্যাংক এর কথা বলতে গিয়ে আরেও বলেন,বর্তমান ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আরও চার বা পাঁচ কোটি মানুষকে ব্যাংকিং channel এ নিয়ে আসা নিশ্চয়ই ওদের শেষ সম্বলটুকু লুট করার জন্য নয়, বরং তাদের কাছে ঋণের প্রবাহ পাঠাবার জন্য, যেন তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অধিকারটা তারা পেয়ে যায়। আমি বিনিয়োগ করার কথা বলছি। তা না হলে তাঁরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না।আমাদের দেশে ট্যুরিজম শিল্পকে ঘিরে অর্থাৎ এই ইন্ডাস্ট্রি বিকাশের জন্য কোন বিশেষায়িত ব্যাংক নাই । এ সেক্টরে তেমন বিনিয়োগও হচ্ছে না। আমরা যদি ট্যুরিজম কেন্দ্রীক ব্যাংকিং সেবা চালু করতে পারি তাহলে ট্যুরিজম সেক্টর আরো সমৃদ্ধ হবে। পর্যটন খাতকে উন্নত করতে হলে পর্যটকদেরকে বিনিয়োগ সহায়তা খাতে বিনিয়োগের ধরন, কারা পর্যটক, পর্যটন খাতের প্রকার ভেদ ইত্যাদি বুঝে বলে দিতে হবে। কক্সবাজারে যেসব ব্যাংকের শাখা আছে তাদের কর্মকর্তাগণ পর্যটন আমার মনে হয় না। হিল ট্যুরিজম, সী-ট্যুরিজম ও প্রত্নতাত্ত্বিক ট্যুরিজম এই ভাবে পর্যটনকে বিন্যাস করা সম্ভব।
এসব খাতের পর্যটক ভিন্ন। কারণ সমুদ্রপ্রেমী আর পাহাড় প্রেমা এক নয়। এদেশের মানুষ প্রকৃতি প্রেমী, তাদেরকে যদি ঋণ সুবিধা দেয়া যেত তাহলে বহু মানুষ বছরে অন্তত দুই বার ভ্রমনের আনন্দ উপভোগ করার পরিকল্পনা করতো। বিনিয়োগ করার মাধ্যমে পর্যটন সেক্টর সমৃদ্ধ হতো। দেশে ট্যুরিজম DEV ব্যাংক গঠন করা সম্ভব। দেশে যদি অনেক শ্রেণী পেশার জন্য ব্যাংক হতে পারে, যদি পুলিশ ব্যাংক হতে পারে, আনসার-ভিডিপি ব্যাংক হতে পারে, সেনাকল্যাণ সংস্থার ব্যাংক হতে পারে, বিজিবি'র জন্য সীমান্ত ব্যাংক হতে পারে, তাহলে পর্যটন খাতের জন্য পর্যটন উন্নয়ন ব্যাংক হতে পারবে না কেন? ৫৭টি তফসিলি ব্যাংক যখন কক্সবাজারে বিনিয়োগ করছে তারা কিন্তু ট্যুরিজমের ডিমান্ড এন্ড সাপ্লাই বুঝে না। তাদের সিজন বুঝার প্রয়োজনীয়তা হচ্ছে না। কারণ তারা পর্যটককে ঋণ সুবিধা দিচ্ছে না। ঋণ দিচ্ছে অবকাঠামো বা আমদানি রপ্তানি বা কোনো শিল্প ক্ষেত্রে। দেখুন, হাজার হাজার কোটি টাকা পর্যটকরা ব্যয় করে কিন্তু এর সাথে ব্যাংকের কোনো কার্যক্রম জড়িত নেই। এজন্য Tourism Development Bank স্থাপন করে Tourism Project বাড়াতে হবে, নান্দনিকতা সৃষ্টি করতে হবে এই খাতের diversification ঘটাতে ঋণ দিতে হবে। এজন্য ট্যুরিজম খাতের ব্যাংকিং বুঝতে হবে। এ ধরনের ব্যাংক ও ব্যাংকার না থাকার কারনে পর্যটন খাতের বিনিয়োগ ফেরত আসেনা।
তিনি আরো যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন সেটি হলো, আর্থিক খাত ধনী দরিদ্র বৈষম্য বৃদ্ধি করছে, দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার মূল কারণ হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য। বৃটিশরা যখন দেশ পরিচালনা করেছে তখন বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। মানুষ তখন মূল্যায়ন পায়নি। পাকিস্তান আমলেও মানুষ বৈষম্যের স্বীকার হয়েছে। সেই বৈষম্য থেকে বাংগালীকে বাঁচাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন।এখনও প্রধানমন্ত্রী বৈষম্যমুক্ত,ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে সংগ্রাম করে চলেছেন। কিন্তু আমাদের ব্যাংক ও লিজিং খাত সহ সকল আর্থিক খাত প্রতিনিয়ত বৈষম্য সৃষ্টি করে চলেছে। তারা তেলা মাথায় তেল দিচ্ছে। টাকা যার আছে তাকে আরো দিচ্ছে। গরিবকে টাকা দিচ্ছেনা। কৃষককে টাকা দিচ্ছে না। এটাই হলো মূল বৈষম্য। আজ বঙ্গবন্ধুর কথা উঠে আসছে, তিনি একটি জাতি গড়েছেন, নতুন দেশের জন্ম দিয়েছেন,পরিচিতি দিয়েছেন, স্বাধীন ভূখন্ড দিয়েছেন, পতাকা দিয়েছেন, সেই মহান নেতা জাতির পিতার সংগ্রাম ছিলো পশ্চিমাদের সাথে বৈষম্য দূর করা, বাঙালি-পাঞ্জাবি বৈষম্য দূর করা। কিন্তু তা দূর হলেও বাঙালি-বাঙালি বৈষম্য তৈরি হয়েছে এবং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাইশ পরিবারের বৈষম্য নিয়ে তিনি সংগ্রাম করেছেন। এখন বাইশ শত Billionaire পরিবারের সাথে বৈষম্য হচ্ছে ১৬ কোটি মানুষের সাথে। এই বৈষম্য দূর করতে হলে ব্যাংকিং কার্যক্রমে পরিবর্তন দরকার। বৃটিশ এবং পাকিস্তান আমলে যে নিয়মে ব্যাংক পরিচালিত হতো এখনও সে নিয়মে ব্যাংক পরিচালিত হচ্ছে। স্বাধীনতার পরে ব্যাংকের নাম পরিবর্তন হলেও এর দর্শন, মিশন, ভিশন পরিবর্তন হয়নি।
স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিলো বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, আর এটাই হলো স্বাধীনতার চেতনা। কিন্তু ব্যাংকগুলো কি স্বাধীনতার অর্থনৈতিক চেতনা প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে? এখানে কী বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক চিন্তা প্রতিষ্ঠা হয়েছে? বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে, স্বাধীনতার চেতনা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে, ব্যাংকগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত হতে হবে। আমার কথায় কেউ হয়তো কষ্ট পেতে পারেন, কিন্তু এটাই বাস্তব এবং যৌক্তিক। উন্নত দেশ গড়ার স্বার্থে ব্যাংকগুলোকে বৃটিশ ও পাকিস্তানি কনসেপ্ট থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মতবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ব্যাংকগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। তাহলে বাংলাদেশের উন্নয়ন বিস্ময়কর গতিতে এগিয়ে যাবে।
এ বইয়ে তিনি মূলত দেখাতে চেয়েছেন কিভাবে অর্থনীতির পরিবর্তন ও নতুন উন্নয়নের বিকাশ ঘটানো যায় তার মূল মন্ত্র। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, যুদ্ধ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে তা শুধু সেনানায়কদের কাছে ছেড়ে দেওয়া যায় না। অর্থনৈতিক সমস্যাও এত জরুরি যে, এ সব সমস্যার সমাধানের জন্য শুধু অর্থনীতিবিদদের উপর নির্ভর করা বাঞ্ছনীয় নয়। নিজেদেরও তদারকির মাধ্যমে অর্থনৈতিক জ্ঞান অর্জন করতে হয়। এই বইটি, অর্থনীতি নামক হতাশাবাদী সমাজকে পরিবর্তনের একটি নতুন ধারাবাক হিসেবে সাধারণ মানুষকে উদ্দিপ্ত করবে অর্থনৈতিক জ্ঞান বিকাশে।
সময় জার্নাল/ এসএম
Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.
উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ
কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল