ডাঃ আহমেদ জোবায়ের :
সময় ও নদীর স্রোত কাহারো জন্য অপেক্ষা করেনা।
সময় ও স্রোত বহমান।
বিভিন্ন সময়ে এমন কিছু ঘটনা আমাদের দেশে ও সমাজে ঘটে, যা আমাদের বাকরুদ্ধ করে দেয়।
আমরা স্তব্ধ হয়ে যাই। আমরা শোকে মাতম তুলি।
কিন্ত ঘটনাগুলো ঘটার মূল কারণটিতে আমরা যেতে চাইনা। আমরা বিভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করাই।
কিন্ত আসল কারণটি কোথায় তা নিয়ে খুব কম মানুষই ভাবেন।
ঘটনা ১ :
সময় ২০১৩, ১৬ আগস্ট।
রাজধানীর চেমেলীবাগের নিজ ফ্লাটে খুন হলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও উনার স্ত্রী স্বপ্না রহমান।
খুনী উনাদের অতি আদরে পালিত কন্য ঐশী।
ইতিমধ্যেই বিচার শেষ হয়েছে।
নিম্ন আদালতে ঐশীর ফাঁসি হলেও উচ্চ আদালত তা কমিয়ে যাবতজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
কাশিমপুর কারাগারই এখন ঐশীর নিবাস।
ও লেভেলের ছাত্রী ১৬ বছর বয়স্কা একটা মেয়েকে মাসে লাখ টাকা হাত খরচ দেওয়া হতো।
সে যা চাইতো তাই দেওয়া হতো।
কোন শাসন ছিলো না।
বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে থাকতো দামী রেস্টুরেন্ট গুলোতে।
নেশার জগতে নিজেকে ডুবিয়ে দেয় ঐশী।
এই মেয়েটি আজ কাশিমপুরে থাকার কথা ছিলো না
তার জীবনের পরিনতি এমন হবার কথা ছিলো।
একটা সুন্দর জীবন কেন পেলো না ঐশী এই প্রশ্ন করার কথা ছিলো সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের।
একটা সন্তানের জীবনের সবচেয়ে আপনজন যারা তাকে মায়া ও আদরে ভরিয়ে রেখেছেন,যখন যা চেয়েছেন দিয়েছেন, সেই মেয়েটি তার মা বাবাকে কুপিয়ে হত্যা করতে তার হাত কাঁপলোনা??
তার মনোজগতে শিহরণ জাগলো না এই ভেবে বাবা মা ছাড়া এই পৃথিবীটা তার জন্য কতটা শুন্যতায় ভরে যাবে??
একটা ১৬ বছরের মেয়ে এতটা হিংস্র হয়ে গেলো কেন??
ঘটনা ২
আজ থেকে ৫ বছর আগের কথা।
জায়গীরদার সাহেবের একমাত্র ছেলেটা এসএসসি পাশ করলো ছেলের বায়না তাকে মোটর সাইকেল কিনে দিতে হবে। বাবা বেকার।ভাইদের সাহায্য সংসার চলে।
ছেলেটি ছিলো বাবার বড় সন্তান।বাবার ক্রাইসিস সে বুঝতে চাইলো না মোটর সাইকেল আদায় করে নিলো। ছেলের মনে
আঘাত না দিতে জায়গীরদার সাহেব বাইক কিনে দিলেন।
এক সপ্তাহ পর রাস্তায় স্পীড স্পীড খেলতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করে ছেলেটি।
স্পট ডেথ্।কফিনের সামনে আহাজারি করছিলেন জায়গীরদার সাহেব। উনার স্ত্রীর বুক ফাটা আর্তনাদ আজো আমার কানে ভাসে।।
এই মৃত্যুর দায় আপনি কাকে দিবেন?
ঘটনা ৩
বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকান্ডটি আমরা ভুলিনাই।সারাদেশের মানুষ কেঁদেছিলো এই নির্মম ও নৃশংস ঘটনায়।
আবরার ফাহাদের দুঃখিনী মায়ের বুক খালি করলো যারা তারাও তো বিভিন্ন মায়ের সন্তান।
সেই মায়েরা তাদের সন্তানকে অনেক আদর ও যত্ন নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন বুয়েটের মত দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য।
তারা তো সবাই মেধাবী ছিলো।দেখতে মানুষের মত।কি সুন্দর ছেলে গুলো।
সেই ছেলে গুলো কিভাবে তাদের সহপাঠী ও জুনিয়র একজনকে এভাবে পিঠিয়ে মেরে ফেলতে পারে।
মেরে ফেলার পরও সিসিটিভি ফুটেজে তাদের মধ্যে তেমন ভাবান্তর দেখা যায়নি।।
কিভাবে এই ছেলেগুলোর মনোজগত এতটা পৈশাচিক হয়ে উঠলো, তার নেপথ্যের কারণ নিয়ে ভেবেছি কি আমরা??
ঘটনা ৪
কিছুদিন আগে আমার চেম্বারে মেডিসিন কোম্পানির একজন এস আর এর সাথে কথা হলো।
এস আর যারা, তাদের কাজ হলো মেডিসিন গুলো অর্ডার অনুযায়ী বুঝিয়ে দেওয়া ও বিল কালেকশন করা। কথায় কথায় বললো, স্যার আমরা অনেক কষ্টে বড় হয়েছি। বাবা দিন মজুর ছিলেন। দিন এনে দিন খাওয়ার অবস্থা তখন ছিলো। বড় ভাই লেখাপড়া করতে পারেননি। আমি আর ছোট ভাই এইসএসসি অব্দি পড়েছি। বৃদ্ধ বাবা মা আমার। অনেক কষ্ট করেছেন আমাদের জন্য। মানুষের মাটি কাটতে দেখেছি। মাটি বইতে বইতে বাবার মাথার চুল গুলো উঠে গেছে।
মায়ের পরনে ভালো কাপড় ছিলো না। বছরে একবার মায়ের জন্য দুইটা কাপড় কিনতেন বাবা। সারা বছর সেই কাপড়ে চলতো।।
আমাদের দুই ভাইয়ের বিয়ের বয়স হলেও আমরা এখনো বিয়ে করিনি। কারণ আমরা যা ইনকাম করি, বাবা মা কে আরামে রাখতে পারছি। অন্তত আমি বিয়ে করবো না। ছোট ভাইটির বিয়ে দিবো। টাকা জমাচ্ছি। মা বাবা আমাদের অনেক কিছু দিতে পারেননি ঠিক, কিন্ত বুকভরা ভালবাসা ও আদর দিয়েছেন।
সারাজীবন আমাদের জন্যই করে গেলেন।
আমরা উনাদের কোন কষ্ট সহ্য করতে পারবো না।
ছেলেটির কথা শুনে আমার চোখ গুলো অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো।।
এই ঘটনা গুলো আমাদের কি বার্তা দিচ্ছে তা নিয়ে আমার বক্তব্য।
জীবন কখনো সরল রেখায় চলেনা। জীবনের পথ মসৃণ নয়, বরং কন্টকময়।। সব দিন একরকম যায়না। জীবন মানেই এক সমুদ্র কষ্টের সমাহার। এখানে কষ্ট আছে, অভাব আছে, ক্রাইসিস আছে, বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্ত আছে। এক জীবনে সব পাওয়া হয়না। সব পেতে নেই এখানে। জীবনে আশাভঙ্গ হয়।
স্বপ্নগুলো মলিন হয়ে যায়। জীবনে অশ্রুসিক্ত হতে হয়।
জীবনে কখনো কখনো হেরে গিয়ে জিতে যেতে হয়।
এক জীবনে ধৈর্য্য ধরতে জানতে হয়।
নিজের কথা না ভেবে অন্যের পাশে দাঁড়াতে হয়।
অন্যকে কাঁদিয়ে হাসার মাঝে যে সুখ নেই।
বরং নিজে কেঁদে অন্যকে হাসানোর নাম জীবন।
তো এই জীবনের শিক্ষাটা কে দিবে আমাদের সন্তানদের। পরবর্তী প্রজন্মকে জীবনের এমনতর রুপের সাথে কি পরিচয় করিয়ে দিবে?
বাবা মা ও পরিবার। এই দায়িত্বটা তাদের।
সন্তান যা চায় তাই যদি দিয়ে দেন,তবে তার ভেতর অনুভূতি জাগবে কিভাবে। আপনি কখনো এটা ভেবেছেন, আপনার সন্তান আপনাকে বুঝে কিনা?
আপনি যে জীবনের গ্লানি টেনে সন্তান সন্তান করছেন, তার বেসিক চাহিদা পূরণ করার পরেও অন্যায় আবদার রক্ষা করে চলেছেন, আপনার কলিজার টুকরো বাচ্চাটার মলিন মুখ আপনি সইতে পারেননা কিন্ত সে কি কখনো ভেবেছে তার আবদার পূরণ করতে গিয়ে আপনার কতটা কষ্ট হয়।
তার গায়ে দামী ব্রান্ডের জামা দিচ্ছেন, সে কি খেয়াল করছে তার বাবার জুতাটা কতটা মলিন।
তার হাতে দামী এন্ড্রয়েড ফোন দিচ্ছেন কিন্ত সেই সন্তান কি ভেবেছে কখনো আমার বাবা কত কষ্ট করে টাকা ইনকাম করে?
আপনারাই আপনাদের সন্তানদের অমানুষ ও সেল্ফিস বানাচ্ছেন।
আপনারা তাদের ভেতর এমপ্যাথি বা সমানুভূতি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। একা ভালো থাকা যায়না।
সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকার নামই জীবন এই শিক্ষা দিতে পারেননি।
কিছু দিতে না পারলেও বাবা মা যে বুকভরা মায়া দিয়ে সন্তানকে আগলে রাখে তা তাদের অনুভূতিতে আনতে পারেননি।।
আপনারা সন্তানের অন্যায় ইচ্ছা পূরণ করেই দায়িত্ব পালন করে গেছেন কিন্ত তাদেরকে জীবনের গল্প বলেননি।
মানুষকে কষ্ট দিতে নেই।
অন্যায্য ভাবে কাউকে যন্ত্রণা দিতে নেই, অন্যের ব্যাথাকে নিজের মত অনুভব করার শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন আপনারা।
যার ফলশ্রুতিতেই উপরের চারটা ঘটনার অবতারণা।
আর কিছু দিতে না পেরেও জীবনের সহজ শিক্ষাটা দিনমুজুর বাবা তার সন্তানদের দিতে পেরেছেন বলেই সন্তান আজ তার দায় মিটাচ্ছে।
আপনার সন্তানকে মানুষ করতে চাইলে তাকে সঙ্গ দিন। বন্ধুর মত মিশতে শিখুন। তাকে কষ্ট করতে দিন।
জীবনের আরেক নাম কষ্টের নদী, সেই নদীতে সাঁতরে পার হবার জন্য যোগ্য করে তুলুন।
মাঝে মাঝে স্কুল থেকে ফেরার সময় হেঁটে বাসায় আনুন। গাড়িতে চললে রিক্সায় চড়ান।
আদর স্নেহ দিন তবে অন্যায় আবদার রক্ষা করে নয়।আপনার অঢেল টাকা থাকলেও নয়। মানুষের জীবন দেখতে দিন তাদের।
মানুষ জীবনে কত কষ্ট করে তা দেখান।
এক জীবনে কত টানাপোড়েন, কত অপ্রাপ্তি তারপর ও জীবনের যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায় যদি প্রচেষ্টা থাকে তা শিখান।।
তাকে শিখান ব্রান্ড এর ঘড়ি,জামা জুতা,দামী মোবাইল এর নাম জীবন নয়।
জামার দাম নিয়ে বন্ধুদের সাথে কম্পেয়ার করার নাম জীবন নয়।।
জীবন হলো শেয়ার করা।মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
অন্যের মুখে হাসি ফুটানো।কাউকে কষ্ট না দেওয়া।
একটা কটু কথা বলে আঘাত না দেওয়া।অন্যের বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করা।নারীদের সম্মান করা,তাদের মাল না ভাবা।কাউকে না ঠকানো,প্রতারিত না করা।
এগুলোকেই জীবন বলে।আলোকিত জীবন।।
সেই আলোর দিশা দিতে হবে বাবা মা কে।
নিজ সন্তানকে আলোর পথে টেনে নিয়ে যেতে হয় বাবা মা কেই।।
সেই দায়িত্ব আজ অবহেলা করলে,আগামীকাল তার ফল নিশ্চিত ভোগ করতে হবে।।
সিদ্ধান্ত আপনার।।