মিজানুর রহমান খান :
ইংরেজিতে একটা কথা আছে- টিপ অব দ্য আইসবার্গ। বিশাল কোনো জিনিসের ক্ষুদ্র একটি অংশ বোঝাতে এটি ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি এই টিপ অব দ্য আইসবার্গের মতো। সমুদ্রে ভাসমান বরফের বিশাল পর্বতের সামান্য যে অংশ উপরে ভাসতে দেখা যায় বাংলাদেশে মহামারির শুধু সেটুকুই আমরা দেখতে পাচ্ছি।
আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান আমরা রোজ পাই সেটা আসল পরিস্থিতির খুবই ক্ষুদ্র একটি চিত্র। প্রকৃত অবস্থা আরও ভয়াবহ। কারণ বেশিরভাগ মানুষ টেস্ট করায় না। আবার সবাই হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করে না। সরকারি টেস্ট করাতে প্রভাবশালী হতে হয়। আর হাসপাতালে মারা যেতে চাইলে হতে হয় বিত্তশালী। প্রতিদিন মৃত্যুর যে হিসেব পাওয়া যায় তার বাইরে বাড়িতে এবং কমিউনিটিতেও প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে যারা রয়ে যায় দৈনিক হিসেবের বাইরে।
একজনের বেসরকারিভাবে টেস্ট করাতে লাগে সাড়ে তিন হাজার টাকা। পরীক্ষা করাতে হলে একটি পরিবারের সবাইকে করাতে হয়, নাহলে কোনো লাভ হয় না। তখন চার সদস্যের একটি পরিবারের খরচ হয় পনের হাজার টাকা।
দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের মধ্যে যদি কেউ আক্রান্ত হয় তাহলে খরচের কথা বিবেচনা করে তার হাসপাতালে যাওয়ারও উপায় নেই। এতদিন আমি জানতাম যে ভর্তি ফি আছে স্কুল ও কলেজে। কিন্তু এবার দেখলাম যে হাসপাতালে মরতে গেলেও প্রথমে কয়েক হাজার টাকা জমা দিতে হয় এন্ট্রি ফি হিসেবে। তার পরে আছে ডজন খানেক টেস্ট, দশ বারোটা ইঞ্জেকশন এবং মুড়ি মুড়কির মতো ওষুধ। সেই সঙ্গে প্রতিদিনের বেডের খরচ তো আছেই।
ইংল্যান্ডে যারা করোনা-ডাক্তার হিসেবে কাজ করছেন তাদের কয়েকজন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের কাছে শুনেছি এসব টেস্ট, ইঞ্জেকশন এবং ওষুধ অপ্রয়োজনীয়। রোগীকে বেঁচে থাকতে হয় তার নিজস্ব রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে অক্সিজেনসহ বাকি যা কিছু দেওয়া হয় তার বেশিরভাগই শুধু তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, কোভিডের চিকিৎসার জন্য নয়। এছাড়াও ভাইরাস একটি সেল্ফ লিমিটিং জিনিস যা নিজেই একসময় ধ্বংস হয়ে যায়। এর জন্য কোনো ওষুধের প্রয়োজন পড়ে না।
রোগী যদি সৌভাগ্যবশত বেঁচে যায়, হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে গিয়ে তার অর্থনৈতিক মৃত্যু ঘটে। বিদায় নেয়ার আগে রোগীকে বলা হয় ফলোআপের জন্য ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে যোগাযোগ করতে। চিন্তাও করতে পারি না কতো অনৈতিক এই পরামর্শ। বিপন্ন ও অসহায় রোগীকে হাসপাতালে আসতে না বলে বলা হয় ব্যক্তিগত ভাবে যোগাযোগের জন্য। হাসপাতাল কি চিকিৎসকের মাছ ধরার জাল?
আমার ব্যক্তিগত কিছু ধারণা - ডাক্তাররা যে এত ওষুধ দেয় আর গণ্ডায় গণ্ডায় টেস্ট করায় তার পেছনে কারণ তার চিকিৎসা জ্ঞানের অজ্ঞতা।
তিনি আশা করেন এর মধ্যে যদি কোনো একটা 'লাইগ্যা' যায়। এমন অনাস্থা আর এমন জবাবদিহিতার অভাব আমি আর কোনো খাতে দেখিনি।
লেখক : সাংবাদিক, বিবিসি বাংলা।