মো: মাসুম মাহমুদ:
আসসালামু আলাইকুম
আজ ৩রা মে ২০২১ইং সোমবার।আমি আজ ২০০২ সালের ৩রা মে শুক্রবার সালাহউদ্দিন-২ লঞ্চডুবির ঘটনার স্মৃতিচারণ করবো আপনাদের সাথে। ৩৬৩ জন যাত্রী ঐ দুর্ঘটনায় মারা যায়, সেই লঞ্চে সেদিন আমিও অবস্থান করছিলাম। অনেকেই জানতে চেয়েছেন সেই ঘটনার কথা।
তাই সবার উদ্দেশ্যে আজ আমি সেই ঘটনার সম্পর্কে বলবো।
তখন আমার বয়স মাত্র ১২ কি ১৩। কোন ক্লাসে পড়ি সঠিক মনে নেই।
আজ থেকে ১৯ বছর আগের ঘটনা। সেদিন যদি মারা যেতাম আজ ১৯ বছর পূর্ণ হতো।
সেদিনের সেই লোমহর্ষক ঘটনা মনে হলে আজও ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে।
তখন আমি রাঙ্গাবালিতে ছোটো বাইশদিয়া গ্রামে বাবা মায়ের সাথে থাকতাম।
গ্রামের এক দুলাভাই এর সাথে নারায়ণগঞ্জ বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে হলো ডায়রিয়া আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। তারপর সেখানে চিকিৎসার পরে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হলো। পরে দুলাভাই সেদিন বিকেলে অর্থাৎ ৩রা মে আমাকে আমাদের গ্রামের আরও তিনজনের সাথে বাড়িতে পাঠানোর জন্য নারায়নগঞ্জ লঞ্চঘাট থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে লঞ্চে উঠিয়ে দিয়েছিলেন।
বৃষ্টি হচ্ছিল আগে থেকেই। শরীরটাও ভালো ছিলো না। মনে পড়ে কাথা গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেলো। এর মধ্যে টের পেলাম লঞ্চ কাত হয়ে পানিতে পড়ে গেছে। লঞ্চের মধ্যে পানি ঢুকতেছে। কিছুই বুঝতে পারলাম না। আল্লাহ কিভাবে যেনো আমাকে লঞ্চের ভিতর থেকে বের করে বাইরে বের করে এনেছেন।
তারপর মনে পড়ে পানিতে অন্ধকারে সাঁতারাচ্ছি। এরমধ্যে লঞ্চ পুরো উল্টে গেছে। লঞ্চের তলা ধরতে চেষ্টা করছিলাম পারছিলাম না। পিচ্ছিল সেজন্য ধরে রাখতে পারছিলাম না। এরপর কতক্ষণ সাঁতার কেটেছি জানিনা। কোনদিকে সাঁতরে ছিলাম তাও জানিনা। মনে আছে গায়ে একটা হাফ শার্ট ছিলো সেটা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম।
হালকা পাতলা ছিলাম তাই হয়তো আল্লাহর রহমতে সাঁতরাতে পারছিলাম।
আবহাওয়া খারাপ হওয়ার দরুন নদীতে কোন নৌকা বা ট্রলারও ছিলোনা যে আমাদের উদ্ধার করবে।
হঠাৎ দূরে দেখি আলো সেদিকে সাঁতরাচ্ছি। দেখলাম একটা লঞ্চ থামানো। সেটার দিকে গেলাম।
ততক্ষণ অক্ষত ছিলাম। সেই লঞ্চ থেকে বড় বড় কাছি ফেলছিলো আমাদের উদ্ধার করার জন্য। কাছিতে হাতের আঙুলে মারাত্মক ব্যাথা পেলাম, তবুও ছাড়িনি। ছেড়ে দিলে হয়তো আজ আর বেঁচে থাকতাম না।
শক্ত করে কাছি ধরলাম টেনে তুললো আমাকে লঞ্চে। ক্লান্ত শরীর আমাদের বসিয়ে রাখলো ইঞ্জিনের পাশে কারন আমাদের শরীর একদম ঠান্ডা ছিলো। এরপর একটা গামছা দিলো আমাকে সেটা জড়িয়ে বসে ছিলাম। কতক্ষণ পরে আনসারদের লুঙ্গি গেঞ্জি দিলো সেগুলো পড়লাম। অসহায় দশা আমাদের।
আমার সাথের তিনজনের দুজনকেও এ লঞ্চে দেখলাম। পরে জানতে পারি বাকি আরেকজন মারা গিয়েছে।
অসহায় দশা আমাদের লঞ্চের যাত্রীদের কাছ থেকে আমাদের টাকা তুলে দেয়া হয়েছিলো। লঞ্চটা ছিলো ঝালকাঠি লাইনের। সকালে বরিশালের দপদপিয়াতে আমাদের নামিয়ে দেয়া হলো। সেখানে এক লোক আমাদের নাস্তা করালো।
কত কঠিন দশা ছিলো আমাদের ভাষায় প্রকাশ করার মত না। তার উপর পোষাকের ওই অবস্থা।
সেখান থেকে আমাদের বাসে তুলে দেওয়া হলো তারাতো বিশ্বাস করেনা আমাদের এই অবস্থা। তারা আমাদের বাসে নিতেই চাইলো না।
তারপরে নিলো তাও বাসের ছাদে।
এরপর বাসে আমরা পটুয়াখালী গেলাম সেখান থেকে রাঙাবালী গেলাম লঞ্চে। পরের দিন বাড়ি পৌঁছালাম।
বাড়িতে বাবা আমাকে দেখে বাবা কান্নায় ভেঙে পড়লো। মা অনেক অসুস্থ ছিলো তবে তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন আমার কিছু একটা হয়েছে। তিনিও কাঁদতে ছিলেন বারবার।
মহান আল্লাহর দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া তিনি আমাকে এই মহা বিপদ থেকে রক্ষা করে আজ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছেন।
পরে জানতে পারি ওই ছোট লঞ্চে প্রায় ৪শ যাত্রী ছিলো। তারমধ্যে সাড়ে তিন'শ এর বেশি যাত্রী মারা যায়। বেঁচে যাওয়া সৌভাগ্যবানদের মধ্যে আমি একজন।
সেদিনের দুর্ঘটনায় যারা মারা গিয়েছেন আমি তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। তাদের আল্লাহ জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন, আমিন।
২০০২ সালের ৩ মে শুক্রবার আনুমানিক রাত ৯.৩০ মিনিটে চাঁদপুরের ষাটনলের কাছে মেঘনা নদীতে ডুবে যায় ঢাকা-নুরাইনপুর-কালাইয়া -চরকাজল -রাঙ্গাবালীর রুটের সালাউদ্দিন-২...
এতে কয়েক শতাধিক যাত্রী নিহত হয় ; এতে পটুৃয়াখালীর রাঙ্গাবালী,বাউফল, কালাইয়া,নুরাইনপুর,কালিশুরী, দশমিনার সহ অন্যান্য ঘাটের ৩৬৩ জন যাত্রী দুর্ঘটনায় মারা যায়...
এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পর নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের তদন্ত কমিটি দায়িত্বে অবহেলার জন্য সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী, জরিপকারকসহ চার কর্মকর্তাকে দায়ী করে। এছাড়া নকশামত লঞ্চ নির্মাণ না করায় মালিককে এবং অতিরিক্ত যাত্রী বহনের জন্য মাস্টারকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু মালিককে জরিমানা ও মাস্টারকে চাকরিচ্যুত করা হলেও অন্যদের শাস্তি দেওয়া হয়নি।
সাধারণ জনগন হিসেবে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে আমার আবেদন এই যে ফিটনেস বিহীন নৌযান চলাচল বন্ধ করুন এবং লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করুন। নিয়ম না মানলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্হা গ্রহণ করুন।