ধর্ম ডেস্ক:
‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘শবে কদর হচ্ছে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও মহিমান্বিত রাত। এই পবিত্র রাতে গুরুত্বের সঙ্গে নামাজ-দোয়া ও জিকির-আজকারসহ প্রত্যেকটি নেক আমলের সীমাহীন ফজিলত বর্ণিত হয়েছে হাদিসে। প্রিয়নবী (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে ইবাদতের মধ্যে রাত জাগবে, তার আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’ (সহিহ বুখারি: ৩৫)
এ রাতে কোরআনুল কারিম নাজিল করা হয়। আবার লাইলাতুল কদরের সম্মানে ‘সুরাতুল কদর’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরাও আছে পবিত্র কোরআনে। এ সুরায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন—‘নিশ্চয় আমি কোরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি কি জানেন, লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাতে ফেরেশতারা ও জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর নির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করেন। এ রাতের ফজর পর্যন্ত প্রশান্তি বর্ষিত হয়।’ (সুরা কদর: ১-৫)
প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ ইমাম ইবনু হাজার আসকালানি (রহ.) তার জগদ্বিখ্যাত সহিহ বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারি’-তে লাইলাতুল কদরের তারিখ নিয়ে আলেমদের অনেকগুলো মতামত ব্যক্ত করেছেন। দলিলভিত্তিক এসব মতামতের মধ্যে ২৭ রমজানে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়। আলেমদের বড় এক জামাত এই মতের পক্ষে। উবাই ইবনু কাব (রা.), ইবনু আব্বাস (রা.), উমর (রা.), ইমাম আবু হানিফা (রহ)-সহ অনেকেই রয়েছেন এই মতের পক্ষে। তাদের অন্যতম দলিল হলো, সাহাবি উবাই ইবনু কাব (রা.) কসম খেয়ে বলতেন, ২৭তম রাতটি লাইলাতুল কদর। (মুসলিম: ২৬৬৮)
তবে, কেউ কেউ রমজানের ২১তম রাতকে শবে কদর মনে করতেন। যেমন ইমাম শাফেয়ি (রহ)। এই মতের পক্ষে দলিল হলো— আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমরা নবী (স.)-এর সাথে রমজানের মধ্য দশকে ইতেকাফ করি। তিনি ২০ তারিখ সকালে বের হয়ে আমাদের সম্বোধন করে বলেন, ‘‘আমাকে কদরের রাত দেখানো হয়েছিলো; পরে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে তার সন্ধান করো। আমি দেখতে পেয়েছি যে, আমি (ওই রাতে) কাদা-পানিতে সেজদা করছি। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসুলের সাথে ইতেকাফ করেছে, সে যেন ফিরে আসে (অর্থাৎ মসজিদ থেকে বের না হয়)।’’ আমরা সবাই ফিরে আসলাম। আমরা আকাশে হালকা মেঘ খণ্ডও দেখতে পাইনি। পরে এমনভাবে মেঘ দেখা দিলো ও জোরে বৃষ্টি হলো যে খেজুরের শাখায় তৈরি মসজিদের ছাদ হতে পানি ঝরতে লাগলো। সালাত শুরু হলে আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে কাদা-পানিতে সেজদা করতে দেখলাম। পরে তাঁর কপালে আমি কাদার চিহ্ন দেখতে পাই। (অর্থাৎ, নবীজির স্বপ্ন সত্য হয়েছে) (বুখারি: ২০১৬)
মুহাদ্দিসগণ অনেকেই এই হাদিস থেকে ব্যাখ্যা করেছেন যে, সেবছর কদর হয়েছিল ২১ তম রাতে। (মুফতি আমিমুল ইহসান (রাহ.) সংকলিত, ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) অনূদিত ফিকহুস সুনান গ্রন্থে (১/৪৮০) এই বিষয়টি টীকায় উল্লেখিত হয়েছে)
আরেকদল আলেমের মতে, শবে কদর শেষ সাত রাতের কোনো এক রাতে। তাদের পক্ষে দলিল হলো- ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে কদরের রাত অনুসন্ধান করো। তোমাদের কেউ যদি দুর্বল অথবা অপারগ হয়ে পড়ে, তবে সে যেন শেষ সাত রাতে অলসতা না করে।’ (মুসলিম: ২৬৫৫)
সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু উনাইস (রা.) রমজানের ২৩তম রাতকে কদরের রাত মনে করতেন (মুসলিম: ২৬৬৫)। তাবেয়ি ইকরামা (রহ.) বলেন, সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত যে, ‘তোমরা ২৪ তম রাতে (কদর) তালাশ করো।’ (বুখারি: ২০২২)
মূলত রমজানের শেষ দশকের প্রত্যেক বিজোড় রাতেই শবে কদরের সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (বুখারি: ২০১৭)
আবার জোড় রাতেও শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। গত শতাব্দির প্রখ্যাত ফকিহ ও মুহাদ্দিস শায়খ ইবনু উসাইমিন (রাহ.)-ও বলেছেন, জোড়-বেজোড় যেকোনো রাতেই কদর হতে পারে। (শারহুল মুমতি: ৬/৪৯২)
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহ.) একটি বিশুদ্ধ হাদিসের আলোকে বলেছেন, যদি রমজান মাস ৩০ দিনে হয়, তবে শেষ দশকের জোড় রাতগুলোতেও কদর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে, যদি রমজান মাস ২৯ দিনের হয়, তাহলে ওই হাদিস অনুযায়ী কদরের রাত পড়বে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে। অতএব, ঈমানদারদের উচিত, রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি রাতেই লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করা। (মাজমুউ ফতোয়া: ২৫/২৮৪-২৮৫)
হাদিসটি হলো—রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা (কদর) সন্ধান করো (শেষ দশকের) অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) নবম রাতে, অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) সপ্তম রাতে, অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) পঞ্চম রাতে, অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) তৃতীয় রাতে এবং অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) শেষ রাতে।’ (তিরমিজি: ৭৯৪) এ হাদিসে আমরা দেখতে পাই যে, যদি রমজান মাস ৩০ দিনের হয়, তাহলে অবশিষ্ট নবম রাতটি হবে রমজানের ২২তম রাত, অবশিষ্ট সপ্তম রাতটি হবে ২৪তম রাত, অবশিষ্ট পঞ্চম রাতটি হবে ২৬তম রাত এবং অবশিষ্ট তৃতীয় রাতটি হবে ২৮তম রাত। অন্যদিকে, যদি রমজান মাস ২৯ দিনের হয়, তাহলে উক্ত হাদিস অনুযায়ী কদরের রাত পড়বে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে। আর এভাবেই সাহাবি আবু সাঈদ খুদরি (রা.) কদরের রাত সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন। (এই গণনা শেষদিক থেকে করা হয়েছে। হাসান বাসরি (রহ) থেকেও এভাবে গণনার পক্ষে দলিল রয়েছে)
তবে, শবে কদরের সম্ভাব্য হিসাবে রমজানের ২৭তম রাতকে অগ্রগণ্য ধরা হয়। হাদিসের গবেষকরা বলেন, রমজান মাসে নির্দিষ্ট কোনো রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য সুস্পষ্ট দলিলের প্রয়োজন। তবে অন্যান্য রাতের চেয়ে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর কোনো একটিতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর এর মধ্যে ২৭তম রাতে হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন হাদিস থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। (ফাতাওয়াউল লাজনাহ আদ্-দায়িমা; সৌদি আরবের ফতোয়াবিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র: ১০/৪১৩)
তবুও একজন মুসলিমের নির্দিষ্ট কোনো রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত নয়। বরং শেষ দশকের সবরাতেই যথাসম্ভব শবে কদরের তালাশ করা উচিত। বিশেষত শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলো। এটিই নবী (স.)-এর আদর্শ। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—‘রমজানের শেষ ১০ রাত শুরু হলে— নবী (স.) কোমর বেঁধে নামতেন। তিনি নিজে রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং তার পরিবারের সবাইকে (ইবাদতের জন্য) জাগিয়ে দিতেন।’ (সহিহ বুখারি: ২০২৪; সহিহ মুসলিম: ১১৭৪)
নবীজি শুধু বেজোড় রাতে নয়, শেষ দশকের প্রতিটি রাতেই ইবাদত করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) (রমজানের) শেষ দশকে যে পরিমাণ আমল করতেন, অন্যকোনো সময়ে সে পরিমাণ আমল করতেন না।’ (মুসলিম: ২৬৭৮)
লাইলাতুল কদর গোপন থাকার কারণ সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ বলেন, লাইলাতুল কদরের রাতটি গোপন রাখার উদ্দেশ্য হলো, যাতে মানুষ শেষ দশকের প্রতিটি রাতকেই কদরের রাত মনে করে ইবাদত করে। হাদিসেও এমনটি এসেছে যে, নবীজিকে কদরের রাতটির কথা তার অন্তর থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়, ফলে তিনি সেটি ভুলে যান। তখন তিনি বলেন, ‘হয়ত এর মধ্যেই তোমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে।’ (বুখারি: ২০২৩)
অতএব আমরা প্রত্যেক বিজোড় রাতকে গুরুত্ব দেবো, আবার জোড় রাতগুলোতে অবহেলা করবো না। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে রমজানের শেষ দশকের প্রত্যেক রাতে ইবাদত-বন্দেগি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমআই