ড. তাজকুরুন্নেছা:
গ্রাম ও শহরের জীবন যাত্রার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পার্থক্য থাকে । মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও গ্রামীণ ও শহুরে জীবন যাত্রার মধ্যে পার্থক্য আছে । ছোটবেলায় আমরা গ্রামীন ইঁদুর ও শহুরে ইঁদুর বন্ধুর গল্প পড়েছি, যেই গল্পে দুই ইঁদুরের জীবন যাত্রার মধ্যে পার্থক্য দেখানো হয়েছিলো এবং তারা নিজেরা নিজেদের জীবন পদ্ধতি পছন্দ করতো। বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের ঈদ উৎযাপন এবং ঈদের দিনের খাবারের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে, তবে কিছু কিছু খাবার দুই স্থানেই হয় । আমরা মুসলমানরা প্রতি বছর দুটি ঈদ পালন করে থাকি (১) ঈদুল ফিতর ও (২) ঈদুল আজহা। মজার ব্যাপার হচ্ছে কিছু কিছু খাবার ঈদ কেন্দ্রিক হয় । অর্থাৎ কিছু খাবার ঈদুল ফিতর কেন্দ্রিক এবং কিছু খাবার ঈদুল আজহা কেন্দ্রিক হয় । আর একটি কথা না বললেই নয়, তা হলো মায়ের হাতের বিশেষ কোনো ঈদের খাবার যা আজীবন ঘুরে ঘুরে আসে প্রতি ঈদে । মায়ের হাতের রান্না পৃথিবীর সকল সন্তানের কাছে প্রিয়। মেয়েরা মায়ের কাছে রান্নাটি শিখে নেই এবং ছেলেরা বৌকে বলে মায়ের কাছে রান্নাটি শিখে নাও, কারণ খাবারটি আমার খুব ভালো লাগে। ডিজিটাল যুগে গ্রাম ও শহরের রাঁধুনিরা ইউটিউব দেখে ঈদের নতুন নতুন খাবার ঘরে ঘরে সংজুক্ত করছেন ।
গ্রামের ঈদের খাবার
বাংলাদেশের গ্রামে প্রতিটি ঘরে ঈদের দিন রান্না হয় তেল পিঠা যার আঞ্চলিক নাম আন্ধাসা (উত্তর বঙ্গে)। ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহা যেকোনো উৎসবেই ঘরে ঘরে তৈরি হয় সেমাই। ঈদের দিনে গ্রামে ঘরে ঘরে রান্না হয় চিকন সেমাই, দুধ সেমাই, হাতের সেমাই, ফিরনি, জর্দা, বুটের ডালের হালুয়া, গাজরের হালুয়া, কড়া ভাজির পিঠা ইত্যাদি। গ্রামাঞ্চলে অতিথি আপ্যায়নের বিশেষ খাবার হলো ঘি বা তেলে ভাজা সেমাই, পায়েস, বিভিন্ন ধরণের নাড়ু , মিষ্টি ও পাপড় ।
ঈদুল আজহাতে পশু কুরবানী হবার কারণে ধনী-গরীব প্রতিটা ঘরে গোস্ত থাকে । সমাজের ধনী মানুষেরা দরিদ্রদের গোস্ত দান করার কারণে সব ঘরে সেদিন গোস্ত রান্না হয়। আল্লাহ তাআলার এ এক আশ্চর্য নেয়ামত। গ্রামের মানুষেরা সকালের নাস্তায় সাধারণত ঈদের পরের দিন গোস্তর সাথে রান্না করেন সাদা ভাত বা চালের আটার সিদ্ধ রুটি অথবা চালের আটার চিতই রুটি, বটের সাথে মাসকলাই ডালের রুটি, নিহারীর সাথে লুচি বা রুটি । ঈদের দিন দুপুরে গোস্তর সাথে ভাত বা পোলাও । গ্রামের মানুষের বিশেষ একটি খাবার হলো- দুই তিন দিনের জাল করা গোস্ত যার স্বাদ রেফ্রিজারেটরের সুবাদে শহরে তো নাই বললেই চলে এবং গ্রামেও কমে যাচ্ছে । এছাড়াও থাকে মাংস দিয়ে ভুনা খিচুড়ি , বিভিন্ন পানীয়, মিষ্টি এবং দই ।
শহরের ঈদের খাবার
শহরেও ঈদের দিনে ঘরে ঘরে তৈরি হয় সেমাই। এছাড়াও রান্না হয় লাচ্ছা, ডোনাট, পুডিং, চটপটি, নুডলস, হালিম । দশ বছর আগে গ্রামে লাচ্ছা হতো না । সেমাই সিদ্ধ হতে সময় লাগে, কিন্তু লাচ্ছা সিদ্ধ হতে সময় লাগে না । তাই মজাদার লাচ্ছা খেতে চাইলে দুধ চিনি মসলা ফুটানোর পর চুলা থেকে নামিয়ে দুধে লাচ্ছা ডুবাতে হবে। লাচ্ছাতে যদি হিট হিয়া ফেলেন তাহলে লাচ্ছা হয়ে যাবে হালুয়া।
ঈদুল আজহাতে শহরের মানুষেরা সকালের নাস্তায় সাধারণত ঈদের পরের দিন গোস্তর সাথে রান্না করেন পরাটা বা রুটি, ঈদের দিন দুপুরে গোস্তর সাথে ভাত বা পোলাও, কাচ্চি, তেহারি, বোরহানি, বারবিকিউ, কাবাব দিয়ে শাহি পোলাও, কোরমা, বিভিন্ন পানীয়, দই, বোরহানি তৈরি করেন।
পরিশেষে বলতে চাই যে, ডিজিটাল যুগের কারণে ইদানীং গ্রামেও পোলাও, কোরমা, কাবাব এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন খাবারের আয়োজন করা হয়। পরিবারের সদস্যরা যে খাবারটি পছন্দ করে তা করার চেষ্টা করব । আর হ্যা, কোন খাবারের স্বাদ কম হলে রাধুনিকে যেনো তিরস্কার না করি, কারণ সে ইচ্ছা করে এটা করেনি, এত গরমের মধ্যে চুলার তাপের কাছে থেকে পরিবারের মানুষের জন্য রান্নাটি করেছেন । ঈদ অর্থ খুশি । নিজে খুশি থাকার চেষ্টা করবো এবং অন্যকে খুশি রাখার চেষ্টা করবো । দরিদ্র বন্ধু বা আত্মীয় বা প্রতিবেশীকে সেমাই, চিনি বা পোশাক উপহার দিয়ে খুশি করার চেষ্টা করবো । সবাই কে ঈদের শুভেচ্ছা ।
ড. তাজকুরুন্নেছা: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, অর্থনীতি বিভাগ
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ