মাহবুব কবির মিলন ::
আমার দিকে তাকিয়ে বন্ধুটি অতি আনন্দ নিয়ে বলল, জানিস সূরা বাকারায় আল্লাহপাক বলেছেন আমাদের বাঁ কাঁধের ফেরেশতা আমরা একটি পাপ করলে একটি গুনাহ লিখেন, আর ডান কাঁধের ফেরেশতা আমরা একটা ভাল বা পূণ্যের কাজ করলে দশটি নেকি বা সওয়াব লিখেন। বাহ! দারুণ জিনিস। আমাদের আর চিন্তার কিছু নেই।
আমি বললাম, হ্যা সত্যিই তাই। আল্লাহপাকের ঘোষণা, মিথ্যার কিছু নেই। তবে এখানে আরো একটা আনন্দের বিষয় আছে তোর জন্য। কি সেটা? বন্ধুর আগ্রহভরা প্রশ্ন।
এখন থেকে এক কাজ করবি তুই। ধর অফিসে দশ জনের কাছ থেকে ঘুষ বা স্পিড মানি নিলি। কয়টা পাপ হল? মানে বাঁ কাঁধের ফেরেশতা কয়টি লিখবে?
একটি পাপে একটি হলে, দশটি পাপ লিখবে। বন্ধুর সহজ সরল উত্তর।
বললাম, বাহ! বেশ। এই তো ধরে ফেলেছিস। এবার প্রতিদিন অফিস থেকে বাড়ি যাবার সময় বাইরে রাস্তায় অনেক ভিক্ষুক বা সাহায্য প্রার্থী বসে থাকে। তুই কমপক্ষে তাঁদের দুই জনকে দান করবি। দুটি নেকির কাজ করলি। এবার বল, ডান কাঁধের ফেরেশতা কয়টি পুণ্য বা সওয়াব লিখবে?
দুই গুণন দশ, বিশটি। তার উত্তর।
গুড বয়! এবার বললাম। তাহলে দিনে কত হল ডান আর বাম মিলে, আয় কাটাকুটি করি। বাঁয়ে দশ জনের ঘুষ সমান দশটা পাপ। ডানে দুই জনকে দান সমান বিশ। তাহলে কাটাকুটি করে তোর কাছে তখনো দশটি পূণ্য থেকে যাবে। তোকে আর পায় কে!! জান্নাত কনফার্ম।
বন্ধু আমার হেসেই পরক্ষণে গম্ভীর হয়ে গেল। বুঝতে পেরেছে আমি কি বলতে চেয়েছি।
এই হচ্ছে কাটাকুটির খেলা। আমাদের পূর্ব পুরুষরাও খেলেছে, আমরা খেলছি। আমাদের সন্তানেরাও খেলবে। এই কাটাকুটি ছোটবেলা থেকেই অহরহ প্রতিনিয়ত শেখানো হচ্ছে আমাদের। আল্লাহপাককে বোকা (নাউজুবিল্লাহ) বানানোর চেষ্টা চলছে আমাদের নিরন্তর।
“একটি দোয়া পড়লেই সত্তর বছরের গুনাহ মাফ”। আরে আমি তো হয়ত সত্তর বছর বাঁচবোই না। কাজে উনসত্তর বছর পর্যন্ত ফাটাফাটি পাপ করে দুইবার দোয়াটি পড়লেই তো ১৪০ বছর পর্যন্ত আগাম পাপও মাফ হয়ে যাবে। কাজেই প্রতি সেকেন্ডে পাপ করলেও তো সমস্যা নেই!! আসলেই কি তাই!!
দান করুন, দান করুন। আপনার প্রতিটি দানে জান্নাতে একটি করে ঘর তুলবেন আল্লাহ। দানের আহ্বানের সাথে একটি বারও কেউ বলবে না (দুই একজন ছাড়া), এই দান হালাল রুটি রুজির হতে হবে। সবাই সেটা জানে, কিন্তু তা পালন করবে না কেউ। শুধু কামাও আর দান কর। জান্নাতে ডুপ্লেক্স, ট্রিপ্লেক্স বাড়ি হতেই থাকবে। আসলেই কি তাই!!!
চলছে কাটাকুটির খেলা।
আরে ভাই! এত কাটাকুটি কেন? আল্লাহপাক অসন্তুষ্ট হন, এমক কাজ একটিও করা যাবে না। ভুলে করে ফেললে, মাফ চেয়ে তওবা করে জীবনের তরে তা ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের প্রতিটি কাজ হবে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির জন্য। এখানে ক্যালকুলেটর বা পাল্লা পাত্থর দিয়ে পাপ পূণ্যের হিসেব নিকেশের কোন অবকাশ নেই।
মসজিদে কমিটির সেক্রেটারি সাহেব ফ্লোর নিলেন। মসজিদের উন্নয়ন কাজের ফিরিস্তি দিয়ে অনেক টাকার প্রয়োজন আছে বলে মাইকে ঘোষণা দিলেন, হাত তুলে বলুন কে কত টাকা দেবেন। প্রথম হাত উঠল পাঁচ লাখ। পরের হাত তিন লাখ, তার পরের হাত দুই লাখ। ইত্যাদি...ইত্যাদি!!
এই হচ্ছে দানের প্রতিযোগিতা!! কাটাকুটির খেলা। মান সন্মানের স্বগৌরব ঘোষণা। বিলুপ্ত হল বা পালিয়ে গেল আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ) এঁর অনেক শিক্ষা, অনেক ফ্যাক্টর। বঞ্চিত হল আমাদের বাচ্চারা ইসলামের মূল শিক্ষা আর আদর্শ থেকে।
রোজা রেখে কিন্তু লুকিয়ে আমরা এক ফোটা পানিও পান করি না। কিন্তু রোজা রেখে হারাম কাজগুলো একটিও ছাড়ি না।
কেন আমাদের এই মানসিকতা!! কারণ আমরা জানি, মাফ পাবার হাজার লক্ষ রাস্তা বা ছিদ্র আছে। সে রাস্তা ভুল হোক আর সঠিক হোক। আর এই রাস্তাগুলোই আমাদের সাহসী করে তুলছে অহরহ পাপ করার কাজে। আল্লাহ হেদায়েত দান করুন আমাদের।
সারাজীবন পূণ্য বা আমল করেও জান্নাত পাওয়া যাবে না, আল্লাহর করুণা ছাড়া। আর সেখানে আমরা মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কাটাকুটির খেলা চালিয়ে যাচ্ছি। হে আমাদের রব, ক্ষমা করুন আমাদের।
লেখক : বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
সময় জার্নাল/এসএ