মেহদী আহমেদ :
প্রায় পুরো ভারতবর্ষ তখন ইংরেজদের দখলে, বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, যুক্তপ্রদেশ, দিল্লি, মাদ্রাজ, বোম্বাই, ইংরেজরা তখন পাঞ্জাব অভিমুখে, সময়টা ১৮৫৫ সাল।
গায়ের রং কালো, প্রকৃতির বুকে জন্মগ্রহণ করা এক জাতি সারাদিন পরিশ্রম করতে পারে, বলছি সাঁওতালদের কথা, কঠোর পরিশ্রমি এই জাতিকে নানাভাবে শোষণ করেছে ইংরেজরা, জমিতে চাষাবাদ করতো তারা, চাষাবাদের জন্য মহাজন আর জমিদারদের কাছ থেকে নিতো ঋণ, তীব্র সুদের কারনে ফসল আর ঘরে তুলতে পারতো না সাঁওতালরা, অনাহারে, না খেয়ে কাটাতে হতো দিনভর তাদেরকে, অথচ এই ভূমি তাদের, নিজেদের ভূমি, নিজেদের শ্রম কিন্তু লাভবান হতো জমিদার আর মহাজনরা।
সাঁওতাল পরগণার রাজধানী বার্নাহাইট, এর কাছে একটা গ্রাম অবস্থিত নাম ভাগনাডিহির, এই গ্রামের মোড়ল কানু আর সিধুঁ, সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হয় এই দুই ভ্রাতৃদ্বয়ের হাত ধরে।
সাঁওতাল বিদ্রোহের অনেক গল্প আছে, বিদ্রোহের সময়ে নেতার আদেশে পুরো সাঁওতাল পল্লীতে কেউ মজুদ করেনি, একজন আরেকজনের কাছে বিলিয়ে দিয়েছে খাবার, অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজরা বারে বারে পরাজিত হয়েছিলো, না পেরে চতুরতার সমক্ষীন হয়েছিলো তারা, পাগলা হাতি ৫০ টা ছেড়ে দিয়েছিলো পুরো সাঁওতাল পরগণা জুড়ে, কাপুরুষদের মতো সামনাসামনি যুদ্ধ করার সাহস ছিলো না ওদের এজন্য এই চতুরতার আশ্রয়।
দীর্ঘদিন চলা এই বিদ্রোহ নিয়ে আমাদের লেখার বিষয় না, আমরা লিখবো এই বিদ্রোহের তেজ, জয়ের ক্ষুধা কিভাবে পরবর্তীতে আবার জেগে ওঠেছিলো সেটা নিয়ে।
‘আমার অরণ্য মাকে কেউ যদি কেড়ে নিতে চায়, আমার সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে কেউ যদি অন্য সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়, আমার ধর্মকে কেউ যদি খারাপ বা অসভ্য ধর্ম বলে, আমাকে কেউ যদি শুধু শোষণ করে নিতে চায় তবে আমি বিদ্রোহ করবই।’ -বিরশা মুণ্ডা
উর্দ্বু, মারাঠি, বাংলা, হিন্দি ভাষার সাহিত্যে তখন জুয়ার চলে, বলা যায় নব যুগ এসেছে, নব যুগের ছুঁয়া কিন্তু স্পর্শ করতে পারেনি কৃষক শ্রেণিদেরকে, দিনের পর দিন কর বেড়েই চলছে, আরেকদিকে খড়ার কারনে হচ্ছে দূর্ভিক্ষ।
হুট করে ঘোষণা আসলো মুণ্ডা সম্প্রদায় এতদিন ধরে ভুগ করা রাঁচি অঞ্চলের বন আর ব্যবহার করতে পারবে না, ব্যবহার করতে হলে অনুমতি লাগবে প্রশাসনের।
চিরকাল ব্যবহার করেছে মুণ্ডারা এই অঞ্চলের বাঁশ বেত খড়, এই ভূমি ওদের, এই বন ওদের কিন্তু মালিকানা ব্রিটিশদের।
রাঁচি জেলার চাকলাদার গ্রামের এক কৈশোরের নাম বিরশা, বিরশা পড়াশোনা করেছে খ্রিস্টান মিশনারীতে তখন তার মাথায় প্রথম আসে, ধর্মের কুসংস্কারে তার পুরো জাতিকে ঘিরে রেখেছে খ্রিস্টান পাদ্রি আর হিন্দু পুরোহিতরা। আর এই দুই শ্রেণির ওঠাবসা হচ্ছে আবার ইংরেজ এবং জমিদারদের সাথে।
বিরশার পড়াশোনায় মন বসে না, তার খেলতে ইচ্ছে করে না, তার মুখে হাসি নেই, সে শুধু ভাবে, ভাবতেই থাকে, এই ভূমি আমাদের, এই বন আমাদের, এইখানে শ্রম দেই আমরা কিন্তু আমরা কেনো গরীব আর ওরা কেনো আমাদেরকে শোষণ করবে?
যে জাতি ঘুমিয়ে পরে তাকে জাগানো যে ভীষণ কঠিন, অল্প বয়স্ক বিরশা কিভাবে এদেরকে জাগাবে? বিরশা বনে বনে হাটে আর ভাবে কি করবে? সে কি করবে?
যে ধর্মকে ব্যবহার করে ইংরেজ আর হিন্দু জমিদাররা তাদেরকে শোষণ করেছে, বিরশা তাদের বিরুদ্ধে ধর্মকে ব্যবহার করে আন্দোলন করবে।
বিরশা গ্রামে ফিরে এসে বলে, সে তাদের প্রধান দেবতা সিংবোঙ্গার প্রত্যাদেশ পেয়েছে। তিনি বলেছেন, তিনি থাকতে কেনো মুণ্ডারা অন্য বোঙ্গাদের পূজা করলো। তিনিই প্রধান দেবতা। তিনি খুশি হলেই সবাই খুশি।
মুণ্ডারা বিরশার কথা শুনলো, নিজেরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি শুরু করলো, আসলেই, আমরা সিংবোঙ্গাকে খুশি করতে পারিনি। যার কারনে আমাদের এই অবস্থা।
বিরশা এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন, প্রথমত মুণ্ডা সম্প্রদায়কে একত্রিত করতে পারলো। আবার, দ্বিতীয়ত্ব সে ঘোষণা দিলো, বোঙ্গা আমাদের দেবতা, আমাদের দেবতার পূজা আমরা নিজেরাই করবো। কেনো মাঝখানে পুরোহিতদের ব্যবহার করি? এই পূজার কারনে বোঙ্গা কাকে শক্তি দিবে তোমাকে না পুরোহিতকে? দেখছো না পুরোহিত কত সুখে আর আমরা অনাহারে দুঃখে কষ্টে মরি! বোঙ্গার সন্তান আমরা, সুতরাং আমরা নিজেরাই তার পুজা করবো, আজ থেকে পুরোহিতের প্রয়োজন নেই।
উপস্থিত সবাই বললো, ঠিক, ঠিক।
মুন্ডারা বললো, তুমি আমাদেরকে দীক্ষা দাও,
বিরসা বললো, "পশু পাখির উপর অকারণে হিংসা পরিত্যাগ করতে হবে। কুসংস্কার মুক্ত থাকতে হবে। সুন্দর নির্মল জীবন যাপন করো। সৎ সংকল্প নিয়ে বেঁচে থাকো।
নতুন মন্ত্র, নতুন দীক্ষা পেয়ে মুন্ডারা নব উজ্জীবিত, মুন্ডারা বিরসাকে ডাকতো ধাতৃ আবা (বিশ্ব পিতা)।
ধীরে ধীরে পুরো রাঁচি জেলা জুড়ে বিরশার কথা ছড়িয়ে পরলো, দূর দূরান্ত থেকে চাকলাদার গ্রামে নব ধর্মে নব মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার জন্য অনেকেই আসা শুরু করলো, ধাতৃ আবার জয় (বিশ্ব পিতার জয়)।
বিরশার এতো সমর্থন দেখে জমিদার আর মহাজনরা ভয় পেয়ে গেলো, তারা পালাতে থাকলো, ইংরেজদের সহযোগিতা কামনা করলো, আবার রাঁচি গ্রামে গ্রামে পুলিশ পিকেট শুরু করলো, চতুর বিরশা বুঝতে পারলো তার পরিকল্পনায় ফাঁক দেখা দিয়েছে।
চলে এসেছে প্রলয়ের দিন, বিরশার পরিকল্পনা ছিলো, সব জমিদার আর মহাজনদের হত্যা করে পুরো রাঁচি জেলা দখল করে ফেলবে, তারপর শুরু করবে ডিফেন্স যাতে ইংরেজরা আর ঢুকতে না পারে, কিন্তু পরিকল্পনায় ফাঁক দেখা দিয়েছে, পুলিশে পুলিশে পুরো অঞ্চল ছেয়ে গেছে।
বিরশা বললো, তোমরা আজ ফিরে যাও, সিং বোঙ্গা বোধহয় আমাদের উপর খুশি না, তিনি প্রলয়ের নির্দেশ দেননি, অস্ত্র সস্ত্রে সজ্জিত মুন্ডারা ফিরে যাচ্ছে মন খারাপ করে, আজইতো তাদের অধিকার আদায়ের দিন ছিলো কি হলো!
উজ্জীবিত যুবক কয়েকজন আক্রমণ করে বসলো পুলিশ ফাঁড়ি, অতর্কিত আক্রমনে পুলিশরা আহত হতে থাকলো, জ্বালিয়ে দেওয়া হলো ফাঁড়ি কিন্তু কাউকে হত্যা করা হয় নি, যুবকদের তখন বিরশার নির্দেশ মাথায় এসেছে এজন্য।
খবর পেয়ে অনেক পুলিশ জরো হলো, শুরু হলো খণ্ডযুদ্ধ, বিরশা আত্মগোপনে গেলেন, যুদ্ধ চললো কয়েকদিন তারমধ্যে বিরশাও গ্রেফতার হলেন, নানা নির্যাতন করা হলো মুন্ডাদেরকে, বিরশাকে জেলে নিয়ে যাওয়ায় খুন্তুিয়া জেল ঘেরাও করলো মুন্ডারা, দুইদিন ঘেরাও করে রাখলো, কিন্তু কোন আক্রমণ করলো না, তারা ভাবলো বিরশা ভগবান কোন কারন ছাড়া ধরা দেওয়ার কথা না, নিশ্চয়ই কোন কারন আছে, সিং বোঙ্গার নির্দেশ আছে, যার কারনে তিনি গ্রেফতার হয়েছেন,
আড়াই বছরের সাজা পেলেন বিরশা মুন্ডা , সময় তখন ১৮৯৫ সাল।
আবার শুরু হলো অত্যাচার, আবার দলে দলে ফিরলো জমিদার আর মহাজনরা, আবার ফসলের কর নেওয়া শুরু হলো, আবার মুণ্ডারা শোষনের স্বীকার হলো, চলতে থাকলো, উত্তেজনার দাবানল ও বইতে থাকলো মুণ্ডাদের শরীরে, তাদের ভগবান বিরশার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো৷
১৮৯৭ সালের ৩০ নভেম্বর সরকার তাকে মুক্তি দেয়। বিরসার মুক্তিতে মুণ্ডাসহ আদিবাসী সমাজে উৎসবের আমেজ বসে। গ্রামে গ্রামে নাচ-গান ও নাগাড়া বেজে ওঠে।
সময় তখন ১৮৯৯ চারদিকে দূর্ভিক্ষ, ফসল হয়নি, অভাব অনটন তীব্র হলো, মানুষ না খেয়ে মরতে শুরু করলো, কিন্তু জমিদারদের কর বন্ধ হয়নি।
বিরশা জেল থেকে ফিরলেন, গ্রামে গ্রামে গিয়ে কর দিতে নিষেধ করলেন, তিনি ঘোষণা দিলেন জমি আমাদের আমরা কেনো কর দিবো যদি দিতেই হয় ইংরেজদের দিবো কিন্তু মহাজন আর জমিদারদেরকে নয়।
মহাজন আর জমিদাররা মিলিত হতো চুঠিয়া মন্দিরে, আক্রমণ করা হলো এই মন্দিরে, দখল করে ওই মন্দির থেকেই বিদ্রোহ পরিচালনা করতেন বিরশা। এটাই তার নতুন আশ্রয়স্থল।
বিরসা নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা দিলেন বিদ্রোহের, তারিখ হলো ক্রিসমাস ডে এর দিন, , ১৮৯৯ সালের ডিসেম্বরে সাহেবদের বড়দিন উৎসবের ওপর বিরসা নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সিংভূম ও রাঁচির ছয়টি থানায় ২৪ ডিসেম্বর আক্রমণ করে। এ সময় বহু মিশন, গির্জায় আগুন জ্বলতে থাকে। বেশকিছু ইংরেজ সাহেব, মিশনারি, চৌকিদার আহত-নিহত হয়। ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়ে। রাঁচির ডেপুটি কমিশনার স্ট্রিটফিল্ড বিরসাকে ধরার জন্য পুলিশ নিয়ে আসে। কিন্তু বিরসাকে ধরা যায় না।
১৯০০ সালের ৭ জানুয়ারি, আক্রমণ করা হলো খুন্তিয়া থানা, থানা দখল করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো, কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র গ্রহণ করলো না মুন্ডারা।
৯ জানুয়ারি পুলিশ কমিশনার আসলেন, ঘোষণা দিলেন আত্মসমর্পণের, একযোগে তীর নিক্ষেপে অনেক পুলিশ হতাহত হলো, শুরু হলো সংঘর্ষ, অনেকক্ষণ বিরশাদের জয় হলো, কিন্তু শেষপর্যন্ত টিকতে পারলো না তারা আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে।
বনের ভেতর ঢুকা শুরু করলো মুণ্ডারা, সঙ্গে বিরশাও, এভাবে বিদ্রোহ দুমাস চললো, তারপর গ্রেফতার হলেন বিরশা ও তাদের অনেক সহযোগী।
১৯০০ সালের ৩০ মে, বিরসা জেলের খাবার খান না, অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলা হয় বিরসার কলেরা হয়েছে। বিরসা বাঁচবে না। কিন্তু বিরসা আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। হঠাৎ করে ৮ জুন বিরসা আবার অসুস্থ হয়ে পরে। এর পর ৯ জুন সকাল ৮টার দিকে বিরসা রক্ত বমি করতে করতে জ্ঞান হারায়। প্রায় ৯টার দিকে বিরসা মুণ্ডার মৃত্যু হয়। বিরসা মুণ্ডারর মৃত্যুতে হাহাকার করে ওঠে অন্য মুণ্ডারা। বিরসার মৃত্যুর কারণ হিসেবে কলেরা বলা হলেও বিরসার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ও তার মৃত্যুর পূর্ব লক্ষণের সঙ্গে কলেরা রোগের মিল পাওয়া যায়নি। অনেক অভিজ্ঞ ডাক্তার মনে করেন বিরসাকে অর্সেনিক বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল।
মুন্ডা বিদ্রোহের ফলাফল ছিলো সূদুর, ইতিহাস বলবে ইংরেজদের জয় হয়েছে অথচ বিপ্লবীরা কখনোই পরাজিত হয়না,
_ এই বিদ্রোহের ফলেই প্রজাস্বত্ব আইন পাস হয় ১৯০৮ সালে।
_ এই আইনের ফলে মুন্ডাদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদ এবং বেকার খাটানো নিষিদ্ধ হয়।
_ এই আন্দোলন থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে তানা ভগৎ নামে একটা আন্দোলন পরবর্তীতে হয়।
_ সবচেয়ে বড় জিনিস হলো, অনেক দিন পর মুন্ডারা এই আন্দোলনের কারনে নিজেদের অধিকার আদায়ে একত্রিত হয়েছিলো।
মুন্ডা বিদ্রোহের সময় পুলিশ কমিশনার যখন চাকলাদার এলাকায় ঢুকেন তখন দেখেন অনেকগুলো লাশ, লাশগুলো ছিলো যুবক যুবতীদের, যারা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য নিজেদের প্রাণ হাসি মুখে দিয়েছিলো, পুলিশ কমিশনার সঙ্গে সঙ্গেই উনার টুপি খুলেন তারপর টুপি খোলা সালাম জানান এই বিপ্লবীদেরকে।
যুগে যুগে বিরশারাই পৃথিবীতে আসে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, হয়তোবা সফল হয়না কিংবা হয়, কিন্তু ইতিহাসে এরা জায়গা করে নেয়, ইতিহাসে অমর হয়ে থাকে বিপ্লবীরা।
আবুল হাসানের কবিতা দিয়েই শেষ করি
"এমনও সময় আসে
বিপ্লবীর মন শুধু নয়, বনভূমি সেও বড় বেদনায়
বিদ্রোহ জমিয়ে রাখে গাছে গাছে সবুজ পাতায়।"
তথ্যসূত্রঃ ১/ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস, সম্পাদনায় দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
২/ বিদ্রোহ বিপ্লব স্বাধীনতা, লেখক ডঃ নীরদবরণ হাজরা।
লেখক :
শিক্ষার্থী
সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।