মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ-২০২৩: মায়ের দুধের বিকল্প নেই

শুক্রবার, আগস্ট ৪, ২০২৩
বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ-২০২৩: মায়ের দুধের বিকল্প নেই

প্রফেসর ড. মো: নূরুল ইসলাম:

দুধ প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ খাবার। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি স্তরেই রয়েছে দুধের প্রয়োজনীয়তা। খাদ্যের ছয়টি উপাদান সুষম আকারে দুধে বিদ্যমান, যা প্রকৃতির আর কোনো খাদ্যে দেখা যায় না। এজন্য দুধকে একটি পানীয় না বলে উৎকৃষ্ট খাদ্যও বলা হয়। শিশুর জন্য মায়ের দুধ একটি আশির্বাদ। জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত মানবশিশু শুধুমাত্র দুধ খেয়েই জীবন ধারণ করতে পারে। ছয় মাস বয়সের পর হতে মায়ের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য সম্পূরক খাবার যেমন নরম ভাত, মাছ, খিচুরি, ইত্যাদি কিছু কিছু করে খাওয়ানো হয়, যাতে পুষ্টির ঘাটতি না হয়। প্রতিদিন অন্তত ১০-১২ বার মায়ের দুধ খাওয়াতে হয় এবং দুই বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ শিশুকে খাওয়ালে শিশু এবং মা উভয়ই লাভবান হন, সুস্থ ও সবল একটি সংসার গড়ে উঠে। 
পৃথিবীর অনেক দেশের মায়েরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন নয়। যার ফলে অনেকেই শিশুর জন্মের পর বাজারে প্রাপ্ত কৃত্রিম শিশু খাদ্যের দিকে ঝুঁকে পরেন, যা মোটেই কাম্য নয়। কৃত্রিম শিশুখাদ্য শুধুমাত্র তাদেরই দেয়া যেতে পারে, যেখানে মা বা শিশু অসুস্থ বা শারীরিক কোনো জটিলতার কারণে বুকের দুধ খাওয়ানো যাচ্ছে না। মনে রাখতে হবে কৃত্রিম শিশুখাদ্য কখনো মায়ের দুধের বিকল্প নয়। এই অজ্ঞতার জন্য বিশ্বের কোটি কোটি শিশু প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং তাদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ আশাপ্রদ হচ্ছে না। তাই মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯২ সন হতে আগষ্ট মাসের ১-৭ তারিখ বিভিন্ন দেশে “বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ” পালিত হয়ে আসছে। এই কাজটি “ওয়ার্ল্ড এলায়েন্স অব ব্রেষ্ট ফিডিং অ্যাকশন” নামক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) ও  ইউনিসেফের (টঘওঈঊঋ) এর সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও প্রতিবছর “বাংলাদেশ ব্রেষ্ট ফিডিং ফাউÐেশন” কর্তৃক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় পালিত হয়ে থাকে। 

মায়ের দুধ কেন শ্রেষ্ঠ, কেন এর বিকল্প নেই এবং এর উপকারিতার উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো। মায়ের দুধে রয়েছে প্রায় ৮৭% পানি, ১-১.৫% প্রোটিন, ৩-৪% চর্বি, ৬.৫-৭.২% ল্যাকটোজ (দুগ্ধশর্করা), ০.২% মিনারেল (খনিজ) এবং প্রচুর পরিমাণে চর্বিতে এবং পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন। তাছাড়া বিভিন্ন ধরণের বিপাকীয় কর্মে অংশ নেয়ার জন্য দুধে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে এনজাইম। দুধের পানি অন্যান্য খাদ্য উপাদানকে ধারণ করে থাকে। দুধের প্রোটিন প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ প্রোটিন। এতে সকল প্রকার অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিড সঠিক মাত্রায় বিদ্যমান রয়েছে, যা শিশুর স্বাভাবিক বর্ধনে সহায়তা করে থাকে। মায়ের দুধের চর্বিতে বিভিন্ন ধরণের সম্পৃক্ত এবং অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড সহ অনেক প্রয়োজনীয় লিপিড রয়েছে, এগুলো নবজাতকের শক্তির যোগান, মস্তিষ্ক এবং অন্ত্রের বর্ধনসহ বিভিন্ন ধরণের কার্যাদি সম্পাদন করে থাকে। দুধের ল্যাকটোজ প্রকৃতিতে আর কোন খাদ্যে পাওয়া যায় না। এটি একটি ডাই-সাকারাইড, যা ভেঙ্গে গেøাকোজ এবং গ্যালাকটোজ তৈরী হয়। গøুকোজ মস্তিষ্কে শক্তি যোগায় এবং গ্যালাকটোজ মস্তিষ্কের কোষ সতেজ রাখে ও বর্ধনে সাহায্য করে। তাই যেসকল শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণ মায়ের দুধ খেয়ে থাকে তারা বেশী মেধাবী হয়। তাছাড়া মায়ের দুধে প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ যেমন ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম ইত্যাদির উপস্থিতি শিশুর হাড়ের গঠণ মজবুত করে থাকে। 

নবজাতকের প্রথম খাবার হল মায়ের বুকের নিসৃত প্রথম ঘন আঠালো জাতীয় দুধ যা কনস্ট্রাম বা শালদুধ নামে পরিচিত। শালদুধে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে এন্টিবডি (ওমঅ, ওমএ১, ওমএ২, ওমগ), প্রোটিন (কেসিন, আলফা ল্যাকটএলবুমিন, বিটা ল্যাকটোগেøাবিউলিন), পর্যাপ্ত পরিমাণে চর্বি যা ভিটামিন অ,উ,ঊ,ক এবং পলিআনসেসুরেটেড, ফ্যাটিএসিড এর বাহক, তাছাড়া প্রচুর পরিমাণে ল্যাকটোফেরিন, লাইসোজাইম, ও ল্যাকটোপারঅক্সিডেজ এনজাইম ও খনিজ জাতীয় পদার্থ শালদুধে বিদ্যমান। এ সকল খাদ্য উপাদান নবজাতককে বিভিন্ন ধরণের রোগ থেকে রক্ষা করে। এই ঘন শালদুধ নবজাতকের পাকস্থলী এবং অন্ত্রের উপরে পাতলা শক্ত আবরণের সৃষ্টি করে। ফলে রোগ জীবানু এই আবরন ভেদ করে সহজে রক্তে মিশে যেতে পারে না, তাই নবজাতক বিভিন্ন প্রকার রোগ থেকে মুক্তি পেয়ে থাকে। নবজাতকের পেট পরিষ্কার করতে ও জÐিস প্রতিরোধে শালদুধ উল্লেখ যোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। তাছাড়া শালদুধে উচ্চমাত্রায় প্রোটিন, খনিজ ও ভিটামিন থাকার দরুন শিশুর বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। সার্বিকভাবে যেহেতু শালদুধ নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং স্বাভাবিক বর্ধনে সহায়তা করে থাকে, তাই এটিকে নবজাতকের ভ্যাকসিন বলা হয়। শিশু জন্মের এক ঘন্টার মধ্যেই শালদুধ খাওয়ানো শুরু করতে হবে। তা না হলে সম্পূর্ণ গুণাগুণ পাওয়া যাবে না। প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় শালদুধের গুনগত মান কমতে থাকে এবং ৫ দিন পরে এটি স্বাভাবিক দুধে পরিণত হয়। 
দুই বছর পর্যন্ত ব্রেষ্টফিডিং করালে শিশু ও মা উভয়েই বিভিন্ন ভাবে উপকার পেয়ে থাকেন। যেমন শিশুর ক্ষেত্রে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যাবে। যার ফলে ডায়রিয়া, নিমোনিয়া, হুপিংকাশি, কানের প্রদাহ, বেকটোরিয়াল মেনেনজাইটিস, হাঁপানি, শিশু মৃত্যু, স্থুলতা, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, লিকোমিয়ায় ইত্যাদিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পেয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মায়ের দুধ পান করলে শিশু মৃত্যুর হার প্রায় ২০-২২% কমে যায়। 

ব্রেষ্ট ফিডিং মায়েদের জন্যও অনেক উপকারী। যে সকল মায়েরা নিয়মিত দুই বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের ব্রেস্টফিডিং করায়ে থাকেন তাদের বিভিন্ন রোগ যেমন- ব্রেস্ট ক্যানসার, ওভারিয়ান ক্যানসার, এন্ড্রোমেট্রিয়াল ক্যানসার, থাইরয়েড ক্যানসার, টাইপ-২ ডায়বেটিস, হৃদরোগ, উচ্চরক্ত চাপ, উচ্চমাত্রায় কলেস্টেরল হওয়ার  প্রবণতা অনেকাংশে কমে যায়। তাছাড়া ব্রেস্ট ফিডিং করালে রক্তে অক্সিটসিন হরমোন নির্গত হয় যা বাচ্চা জন্মের পর জরায়ুকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। ব্রেস্ট ফিডিং মায়ের সাথে বাচ্চাকে গভীর নাড়ীর বন্ধনে আবদ্ধ করে, যে কোন জায়গায় যে কোন সময় ব্রেস্টফিডিং করানো যায়। এটি পরিবেশ বান্ধব এবং এতে অতিরিক্ত খরচও নাই। মা তাড়াতাড়ি তার গর্ভাবস্থার পূর্বের শারীরিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারে।  

তাই সকল মায়েদের প্রতি বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহের আহবান- আপনারা আপনাদের শিশুকে ব্রেস্ট ফিডিং করান, এবং শিশু ও মায়ের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে একটি সমৃদ্ধ দেশ উপহার দিন।

লেখক: প্রফেসর ড. মো: নূরুল ইসলাম
 ট্রেজারার, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
এবং প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, ডেয়রী বিজ্ঞান বিভাগ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। 


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল