শিরিনা বিথী
আজ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়, শেখ হাসিনা তখন তার ছোট বোন শেখ রেহানা, স্বামী ও দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল সহ পশ্চিম জার্মানীতে অবস্থান করছিলেন। ফলে তারা প্রাণে বেঁচে যান।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশের গণতন্ত্র আর প্রগতিশীলতার রাজনীতি ফেরাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি দেশে ফেরেন। রাজনীতির মতোই প্রকৃতিও ছিল সেদিন ঝঞ্জা-বিক্ষুব্ধ। ছিল কাল বৈশাখীর হাওয়া, বেগ ছিল ঘন্টায় ৬৫ মাইল। প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি আর দূর্যোগও সেদিন গতিরোধ করতে পারেনি গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ মানুষের মিছিল। গ্রাম-গঞ্জ, শহর-নগর-বন্দর সব জায়গা থেকে অধিকার বঞ্চিত মুক্তিপাগল জনতা ছুটে এসেছিল রাজধানী ঢাকায়। তাদের একমাত্র আশার প্রদীপ বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনাকে বরণ করতে। মুশুল ধারার বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে তারা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন ‘নেত্রী’ কখন আসবেন এই প্রতীক্ষায়। অবশেষে বিকেল চারটায় কুর্মিটোলা বিমানবন্দর দিয়ে জনসমুদ্রের জোয়ারে এসে পৌঁছান শেখ হাসিনা। তাকে এক নজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরে বাংলা নগর পর্যন্ত রাস্তাগুলো রূপ নিয়েছিল জনসমুদ্রে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর চরম এক প্রতীকূল পরিবেশে নির্বাসিত প্রবাসী জীবন কাটাতে হয় আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। দেশের মাটিতে পা দিয়েই লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনার জবাবে শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে আমার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’
শেখ হাসিনা বিদেশে থাকাকালেই ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামীলীগ নেতারা তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর নেতারা তার হাতে তুলে দেন দেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যের সাফল্যগাঁথা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগের পতাকা। এরপর থেকে শেখ হাসিনা দলীয় কাউন্সিলে বারবার নির্বাচিত হয়ে দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তার নেতৃত্বে চারবার রাষ্ট্র ক্ষমতার মধ্যে বর্তমানে টানা তৃতীয়বার আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় রয়েছে। আর চারবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন শেখ হাসিনা। তিনবার বিরোধী দলের নেতাও ছিলেন তিনি।
নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে পিতার মতোই অবিচল, দৃঢ় ও সাহসী। তিনি দেশের উন্নয়ন ও জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তিনি তার নিজের দূরদৃষ্টি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দক্ষ রাষ্ট্র চালনায় ইতোমধ্যেই বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দিয়েছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। বেকারত্বের হার কমেছে। নাম লিখিয়েছে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশে পৌঁছে যাওয়া, নৌবাহিনীর সাবমেরিন যুগে প্রবেশ কিংবা সমুদ্রসীমা বিজয়ের মতো ঘটনাগুলো ঘটেছে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কিংবা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারও সম্পন্ন হয়েছে শেখ হাসিনার শাসনামলে। দক্ষ হাতে দৃঢ়তার সাথে দেশ পরিচালনা করার দরুণ পেয়েছেন দেশী-বিদেশী অজস্র স্বীকৃতি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, শেখ হাসিনার দক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনায় কৃষিখাতেও হয়েছে ব্যাপক উন্নতি। পাশাপাশি নারী অধিকার সুরক্ষা এবং নারী-পুরুষের সমান অধিকার অর্থাৎ জেন্ডার বৈষম্য রোধ হয়েছে অনেকখানি। দরিদ্র ছিন্নমূল মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে অর্থাৎ ভূমিহীন গৃহহীন ও ছিন্নমূল পরিবারকে পূনর্বাসন করে অসহায় মানুষকে সহায়তা প্রদান করেছেন। স্বাস্থ্যখাতে বিশেষত শিশু মৃত্যু হারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সফলতা সবার নজর কেড়েছে।
এছাড়াও গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তিনি অভূতপূর্ব সহনশীলতা প্রদর্শন করেছেন। শিক্ষা ও গবেষণাখাতকেও অসম্ভব গুরুত্ব দিয়েছেন।
কৃষি থেকে মহাকাশ, শিক্ষা থেকে সমুদ্রতল সব কিছুতেই এখন বাংলাদেশের জয়জয়কার। বাংলাদেশের এই ইতিবাচক রূপান্তরের পেছনে মূল কৃতিত্বটা বর্তায় বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপরই। কিন্তু উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রা সহজ ছিল না। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে তুলে আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জঙ্গীবাদ, দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্র, শরণার্থী সমস্যার মতো বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে মহামারী করোনা ভাইরাস। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে তার নেতৃত্বে মহামারী করোনা ভাইরাস মোকাবেলা করে বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে প্রশংসিত।
সর্বশেষ বলতে পারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন দেখে গিয়েছেন সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাবার চেষ্টায় অবিরল কাজ করে চলেছেন। সর্বোপরি একটি উন্নত, আধুনিক, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক ও কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
সময় জার্নাল/এসএ