মিজানুর রহমান:
মূল্যস্ফীতি হলে খাদ্যদ্রব্য, পোশাক বাড়িভাড়া নিত্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিষের দাম বেড়ে যায়। মানুষ এসব সেবা বা পণ্য কিনতে আগের চেয়ে বেশী টাকা খরচ করতে হয়। আয়ের পরিবর্তন না হলে মানুষ আগের চেয়ে কম ক্রয় করতে বাধ্য হয়।তখন তাদের সঞ্চয় কমে যায় অন্যান্য খাতের খরচ কমাতে বাধ্য হয়।
ভালো নেই সীমিত আয়ের মানুষগুলো। ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে প্রতিবন্ধকতায় বাজার প্রভাবিত করছে। কঠিন চ্যালেন্জিং এর মধ্যে ধাবিত হচ্ছে-- দেশের অর্থনীতি। অর্থনীতিতে মূদ্রার পরিমান বেড়ে যাওয়াটা ভালো লক্ষণ নয়।নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে মূল্য বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি আমাদেরকে অসহনীয় করে তুলছে।অর্থনীতির ভাষায় মূদ্রার সরবরাহের পরিমান যখন বেড়ে যায় তখনই সমস্যা দেখা দেয়।এ বেড়ে যাওয়াটা সরকারের অনেক হিসাব নিকাশ ও আছে।মূল্যস্ফীতির কারণে শহরের সীমিত আয়ের মানুষগুলো তার বাজেট প্রতিনিয়ত কাটছাঁট করতে হচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রীদ্বয় মূল্যস্ফীতি নিয়ে কোন আশারবাণী ও দিতে পারছে না। গত ২৯শে আগষ্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহীর কমিটির সভার (একনেক)পর সাংবাদিকদের সাথে, পরিকল্পনা মন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেন '''মূল্যস্ফীতি কমানো যাচ্ছে না, কমাতে হলে দেশের স্বার্থে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে আগষ্ট মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.৯২ শতাংশ খাদ্যের ক্ষেত্রে আরও বেশী। খাদ্যস্ফীতি ১২.৫৪ শতাংশ( যা ১১বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ)।খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৭.৯৫ শতাংশ। মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেন আগষ্ট মাসে ডিম মুরগী ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম উর্দ্ধমূখী ছিল।মানুষের যন্ত্রণা বেড়েছে তবে চালের দাম স্থিতিশীল ছিল।মন্ত্রী বলেন উন্নয়নশীল দেশের জন্য মূল্যস্ফীতি আর্শীবাদ।তবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে তা নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেন্জিং।
গত দুইমাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমার পর গত আগষ্টে তা আবার বেড়েছে। তবে লক্ষনীয় যে গ্রাম ও শহরে সমান তালে খাদ্যমূল্যস্ফীতি বেড়েছে যা ছিল ১২ শতাংশের উপরে। এতে করে মানুষের ভোগান্তি ও বেশ বেড়েছে। আগষ্টে মূল্যস্ফীতি ৯.৯২ শতাংশ হওয়ার অর্থ হল গত বছর আগষ্ট মাসে যে পণ্য ১০০ টাকায় ক্রয় করা যেত তা বর্তমানে ১০৯.৯২ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে। অন্যদিকে দুই কেজি মোটা চাল ক্রয় করতে আগষ্ট/২২ মাসে লাগতো ১০০/ টাকা বর্তমানে তা লাগে ১১২.৫৪/ টাকা।""'
সম্প্রতি একনেক বৈঠক শেষে(১২সেপ্টেম্বর) সাংবাদিকদের সাথে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল ইসলাম মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে আরও বলেন, ''চাল আমদানিতে করভার ছিল ৬০ শতাংশ বর্তমানে তা ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। নীতি সুদহার দু,বার বাড়ানো হয়েছে । এখন আর নয়-ছয় সুদহার কার্যকর নয়।কয়েক মাস আগেই তা বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে নীতিসুদ হার বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার।তিনি আরও বলেন মূল্যস্ফীতির চক্রে আমরা পড়ে গেছি আশা করি আগামী নভেম্বর/২৩ থেকে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।"
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে যদি পিছনে তাকাই দেশে মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০২০- ২১ ছিল ৫.৫৬ শতাংশ, ২০২১-২২ এ ৬.১৫ শতাংশ, ২০২২-২৩ এ ৯.০২ জুলাই/২৩ এ মূল্যস্ফীতি হলো ৯.৬৬ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির জন্য সরকার সবসময় রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করে । বাস্তবে কি তাই? যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশ বর্তমানে তা নামিয়ে ৩ শতাংশে,ভারত ৮--৯ শতাংশ ছিল এখন ৫.০৭, শ্রীলংকা ৪৯ শতাংশ থেকে ৬.০৩ শতাংশ, পাকিস্তান ৪০ শতাংশ থেকে ২৮ শতাংশ, আর বাংলাদেশে বর্তমানে ৯.৯২ শতাংশে হাবুডুবু খাচ্ছে।
কয়েকটি দেশের মূল্যস্ফীতি দেয়ার অর্থ হলো রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যমূল্য বেড়েছে ঠিকই পরবর্তীতে অনেক দেশ সহনীয় পর্যায় এসেছে ।কারণ জ্বালানি তেলের মূল্যের উপর বাজার উঠানামা করে, এবং তা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে যেমন ২০১৬ সালে জুন মাসে তেলের প্রতি ব্যারেলের মূল্য ছিল ৬১ ডলার।পুটিন যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে তার আগের মাসে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তেলের দাম ছিল ৯৬ ডলার,যুদ্ধ শুরু হলে ২০২২ সালের মে মাসে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলারে উঠে। আগষ্ট/২৩ মাসে তেলের ব্যারেল প্রতি মূল্য ৮০ ডলারে নেমে এসেছে। বর্তমানে যুদ্ধ পূর্ব দামের চেয়ে ও তেলের দাম কম।তাই যুদ্ধের কারণে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এ ধারণা থেকে বেড়িয়ে এসে দেশের বাস্তবতার নিরিখে সরকারকে মূলস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে।জনগনকে স্বস্তি দিতে হবে।
বিশ্বব্যাপী অনেক দেশে গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেলেও বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলছে, এর লাগাম টানতে ব্যর্থ হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে পড়া শ্রীলংকা ও মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে কিন্ত আমরা পারিনি।
এমন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতি হ্রাসের তিনটি পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন :
(ক) বৈদেশিক মুদ্রার হার স্থিতিশীল রাখা।
(খ)সুদহার বাড়ানো
(গ)ক্রটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা।
সরবরাহ, চাহিদা,ঘাটতির বিষয়টি মনিটরিং করতে হবে। ব্যাংকগুলোতে এলসি বা ঋণ পত্রের অর্থ পরিশোধের সময়সীমা কমিয়ে আন;] যাতে আমদানি করা পণ্যের মজুদের সময় না পায় এবং আমদানিকৃত পণ্য অতিদ্রুত বাজারে চলে যায়।উপরোক্ত পরামর্শগুলো বাস্তবায়িত হলে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেতে বাধ্য।
লেখক: মিজানুর রহমান
কলামিস্ট ও ব্যাংকার।