নিজস্ব প্রতিবেদক:
হাসেম। ২০০৫ সালে অপরাধ জগতে ‘নাম লিখিয়ে’ ছদ্মবেশ নেন দরবেশ বাবার। গড়ে তোলেন প্রতারণার ফাঁদ। স্বল্পশিক্ষিত সহজ-সরল প্রবাসীদের টার্গেট করে কৌশলে হাতিয়ে নিতেন অর্থ। প্রথম দিকে বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপনও দিতেন। পরে ২০১৬ সাল থেকে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি ইউটিউব ও ফেসবুকেও বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করেন।
এরপর থেকে প্রতিমাসে ফেসবুকে চার লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করেন প্রতারক হাসেম। এমনকি পোস্ট বুস্টও করতেন, যাতে তার বিজ্ঞাপন সকল মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। এভাবে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন হাসেম। ফ্ল্যাট, বাড়ি-গাড়ি কিনে রীতিমতো আলিশান জীবনযাপন করতেন। তবে ভুক্তভোগী এক নার্সের মামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন ভয়ংকর এই প্রতারক। পরে জিজ্ঞাসাবাদে মিলেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
মূলত মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত স্বল্পশিক্ষিত প্রবাসী বাঙালিদের টার্গেট করে সৌদি আরব, দুবাই, ওমানসহ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে নিজের বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন হাসেম। এছাড়াও ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ও ফ্রান্সেও বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন। পরে ফাঁদে পা দেওয়া অসংখ্য মানুষের কাছে নিজেকে ‘দরবেশ বাবা’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে নানা কৌশলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন।
রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সিআইডি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান প্রতারক হাসেমকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, প্রতারক হাসেম হিন্দি ও আরবি ভাষায় কথা বলায় পারদর্শী। জ্বিন-পরীর নাম করে বিভিন্ন রকম কণ্ঠে কথা বলে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে নানা কৌশলে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিতেন তিনি।
যেভাবে ধরা পড়লেন ‘দরবেশ বাবা’
সরকারি একটি হাসপাতালের নার্স হিসেবে চাকরির বয়স শেষে অবসরে গিয়েছিলেন ভুক্তভোগী রহিমা (ছদ্মদাম)। স্বামী পেশায় চিকিৎসক, আর ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করেন বিদেশে। প্রথম দিকে সবকিছু ঠিকঠাক চললেও রহিমা চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর থেকে তার স্বামী তাকে ‘অবহেলা’ করা শুরু করেন। পরে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করতে ‘দরবেশ বাবার’ শরণাপন্ন হন রহিমা। এরপর বিভিন্ন সময়ে নানা কৌশলে ‘দরবেশ বাবা’র ছদ্মবেশে প্রতারক হাসেম তার কাছ থেকে প্রায় সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
পরবর্তীতে একসময় রহিমা যখন বুঝতে পারেন তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন, তখন মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করেন। এরপর সেই মামলার তদন্তের সূত্র ধরে রাজধানীর উত্তরা ও ভোলা জেলা থেকে সহযোগী তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিল হাসানসহ ‘দরবেশ বাবা’ মো. হাসেমকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সিআইডি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান জানিয়েছেন, রহিমার মতো অনেক নারীর কাছ থেকে ‘দরবেশ বাবা’র পরিচয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন হাসেম ও তানজিল। পরে সেই টাকা দিয়ে তারা বানিয়েছেন আলিশান বাড়ি, কিনেছেন ফ্ল্যাট-গাড়ি।
রহিমার প্রতারণার ফাঁদে পা দেওয়ার কথা জানিয়ে সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, অবহেলা-অবজ্ঞার একপর্যায়ে স্বামীকে ‘বশে আনা’র কৌশল খুঁজতে থাকেন রহিমা। একসময় ফেসবুকে এমন একটি বিজ্ঞাপন তার নজরে আসে। পরে বাসার কাজের মেয়ের সঙ্গে এ নিয়ে পরামর্শ করলে কাজের মেয়ে তাকে জানান- এমন লোকের কাছে গিয়ে অনেকেই উপকার পেয়েছেন। পরবর্তীতে রহিমা গ্রেফতার তানজিলের মাধ্যমে ‘দরবেশ বাবা’ সেজে প্রতারণা করা হাসেমের শরণাপন্ন হন। এরপর সমস্যা সমাধানের নামে বিভিন্ন সময়ে তানজিলের মাধ্যমে প্রায় সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন প্রতারক হাসেম। রহিমা এসব টাকা বিকাশে পাঠিয়েছিলেন। তিনি মূলত টাকা তানজিলের কাছে পাঠাতেন, পরে তানজিল প্রতারক হাসেমকে টাকা তুলে দিতেন। প্রতারণার ‘গ্রাহক’ ম্যানেজ করে দেওয়ার বিনিময়ে তানজিল হাসেমের কাছ থেকে লুটে নেওয়া অর্থের ৪০ শতাংশ শেয়ার নিতেন।
রহিমার মতো ভুক্তভোগী ফ্রান্স প্রবাসী শাহেদের (ছদ্মনাম) পরিবারও
প্রতারক হাসেম ফ্রান্স প্রবাসী শাহেদকে (৪০) ১২ কোটি টাকার লটারি জিতিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তার কাছ থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এমনকি তার বড় বোনও একই ফাঁদে পা দিয়ে নিজের জমানো টাকাও খুইয়েছেন। এছাড়াও চক্রটি অপর এক ইতালি প্রবাসীর কাছ থেকেও একইভাবে লটারি ও জুয়ায় টাকা জিতিয়ে দেওয়ার কথা বলে আরও প্রায় ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
সিআইডি বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রতারক চক্রের এরকম ২০ থেকে ২৫ জন ক্লায়েন্ট (ভুক্তভোগী) আছে, মালয়েশিয়াতে আছে আরও ১০ থেকে ১২ জন। এরমধ্যে ৫ থেকে ৬ জন ভুক্তভোগী আছেন, যারা প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে গত চার থেকে পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত ‘দরবেশ বাবারূপী’ এই প্রতারককে টাকা দিয়ে আসছে।
এমআই