কাউছার আহমেদ, নোবিপ্রবি : ভ্রমণের আনন্দ প্রতিটি মানুষকেই মূর্ছনা দেয়। নিজে ভালো থাকতে, মন ভালো রাখতে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটাতে কিংবা নিখাদ বিনোদনের আশায় মানুষ ভ্রমণে যায়। বেঁচে থাকার জন্য মনের আনন্দ দরকার। সেই আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় ভ্রমণ করার মাধ্যমে। আর তা যদি হয় শিক্ষাসফর, তাহলে আনন্দের মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যায়।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি) শিক্ষা বিভাগের ১৬ তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনকে স্মৃতিময় করে রাখতে ব্যাচ ট্যুরের আয়োজন করে। ট্যুরকে ঘিরে ছিল ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা। ২ দিনব্যাপী এই ভ্রমণ যাত্রায় গন্তব্য ছিল উদ্ভিদ ও প্রাণীর অভয়ারণ্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মালনীছড়া চা বাগান, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর , রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, মাধবপুর লেক ও চায়ের রাজধানী খ্যাত শ্রীমঙ্গল।
গত ৮ অক্টোবর রাত ১০ ঘটিকায় নোবিপ্রবি ক্যাম্পাস থেকে আমরা যাত্রা শুরু করি । ১১ অক্টোবর সকাল ৫ টায় ক্যাম্পাসে ফিরে আসার মাধ্যমে আমাদের ট্যুরের সমাপ্তি ঘটে। পুরো ট্যুরে সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন কোর্স কো - অর্ডিনেটর সহকারী অধ্যাপক ফাতেমা বেগম পপি ও সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ মো. সিয়াম। ট্যুর এজেন্সি হিসেবে দায়িত্ব ছিলেন রোড টু হ্যাভেন এর উপর।
আমাদের ব্যাচ 'অজেয় ১৬' ৪২ জনের ভ্রমণ সঙ্গী নিয়ে যাত্রা শুরু করি। দীর্ঘ ৯ ঘন্টা ভ্রমণ ক্লান্তি শেষে ভোর ৬ টায় পৌঁছাই চায়ের রাজ্যে সিলেট। সিলেটের বিখ্যাত পানশী রেস্টুরেন্টের সামনে দাড় করায় আমাদের গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা করি। দেরি না করে আমাদের প্রথম গন্তব্য বাংলাদেশের সর্বপ্রথম চা বাগান মালনীছড়া।
মালনীছড়া চা বাগান
মালনীছড়া চা বাগান বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের বৃহত্তম এবং প্রথম প্রতিষ্ঠিত চা বাগান। ১৮৪৯ সালে লর্ড হার্ডসন ১৫০০ একর জায়গার ওপর এটি প্রতিষ্ঠা করেন। মূল সড়কের পাশেই বড় করে লেখা MALNICHERRA-1854। এগিয়ে চললাম বাগান পানে। ঢেউ খেলানো সবুজের চোখ আটকে দেওয়া ছবি বুঝি একটাই পৃথিবীতে। পদব্রজে আমরা এগিয়ে চলছি আর অপরুপ সৌন্দর্যকে নিজের সঙ্গী করে ক্যামেরাবন্দী করেছি। চারপাশে সবুজের সমারোহ। নীল আকাশের নিচে যেন সবুজ গালিচা পেতে আছে সজীব প্রকৃতি। উঁচু-নিচু টিলা এবং টিলাঘেরা সমতলে সবুজের চাষাবাদ। শুধু সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে টিলা বেষ্টিত ছোট ছোট জনপদ। পাহাড়ের কিনার ঘেষে ছুটে গেছে আকাবাঁকা মেঠোপথ। কোন যান্ত্রিক দূষণ নেই। কোথাও আবার ধাবমান পথে ছুটে চলছে রূপালী ঝর্ণাধারা। প্রকৃতির সকল সৌন্দর্যের সম্মিলন যেন এখানে। এমন অন্তহীন সৌন্দর্যে একাকার হয়ে আছে সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগান। এর পরের গন্তব্য ভোলাগঞ্জের পাহাড়ি কন্যা সদা পাথর।
সাদা পাথরের দেশ ভোলাগঞ্জ
ভোলাগঞ্জ সীমান্তে প্রাকৃতিক দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের উঁচু উঁচু পাহাড়। সেই পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণাধারা একদিকে ধলাই নদের পানির যোগানদাতা অন্যদিকে এই পানি প্রবাহই ভোলাগঞ্জের রূপের উৎস। সবুজ পাহাড়, মেঘের হাতছানি আর বর্ষার পাহাড়ি ঢলের সাথে নেমে আসা সাদা পাথর ধলাই নদের বুকে মিলে মিশে ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। যতদূর চোখ যায়, কেবল সাদা পাথর, মাঝখানে স্বচ্ছ নীল পানি, ওপরে নীল আকাশ আর সবুজ পাহাড়ে মেঘের আলিঙন। চারদিকে ছড়িয়ে আছে সাদা পাথর। মনে হয় যেন,প্রকৃতি শুভ্রতার চাদর বিছিয়ে রেখেছে। এ জেন প্রকৃতির এক অপরূপ স্বর্গরাজ্য। সবাই সৌন্দর্যকে নিজের মতো করে ভিডিও, ছবি তুলে নিচ্ছে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সূর্য তখন ঠিক মাথার উপরে। তখন দুপুরের খাবার খাই। দুপুরের খাবার পর্ব শেষে রওনা দিই রাতারগুলের উদ্দেশ্যে। ২.৩০ মিনিটে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট পৌঁছাই। আগে থেকে নৌকা ভাড়া করে রাখা ছিল। সময় নষ্ট না করে গ্রুপ করে নৌকায় উঠে পারি।
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট
রাতারগুল বাংলাদেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট। এটি সিলেট জেলা শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত। রাতারগুল ‘সিলেটের সুন্দরবন' নামে খ্যাত।’বাংলার আমাজন’ নামেও বেশ পরিচিত এই রাতারগুল। রাতারগুল জলাবন বছরে চার থেকে পাঁচ মাস পানির নিচে তলিয়ে থাকে। টানা কয়েকদিন বৃষ্টির কারণে এবার রাতারগুল এ মোহনীয় রূপ ধারণ করেছে। ডুবন্ত গাছের কিছু ডালপালা আছে পানির উপরে ভাসমান। একে একে ৮ টি নৌকার অবস্থান ওয়াচ টাওয়ারের পাশে।সেখানেই ট্যুরের সেরা মুহুর্ত উপভোগ করি। শুরু হয় গান কবিতা আবৃত্তির আড্ডা। নাঈম মোস্তফা, প্রমা গুহ গান গাইতে শুরু করে বাকি সবাই দিচ্ছে হাত তালির মাধ্যমে উৎসাহ আর সবার মুখে গানের বন্দনা। মুখরিত পুরো রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। মুজতবা ফয়সাল নাঈমের কবিতা আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে শেষ হয় সেই আড্ডা। পুরো বিকেল আমরা সেখানে অবস্থা করি। ডুবন্ত সূর্যকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দেই হোটেলের উদ্দেশ্যে। হোটেলে পৌঁছে সবাই ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম করি। তারপর রাতের খাবারের জন্য চলে যাই সিলেটের বিখ্যাত রেস্টুরেন্টে পানশীতে। খাবার শেষে সবাই নিজেদের মতো সময় কাটাই। অনেকেই ঘুরতে যায় হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজারে কেউবা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিজের মতো সময় কাটানো শেষ করে সবাই হোটেল লবিতে পৌঁছায় রাত ১০ টায়। এরই মধ্য দিয়ে আমাদের ট্যুরের প্রথম দিনের সমাপ্তি ঘটে।
পরদিন ১০ অক্টোবর দ্বিতীয় দিনের জন্য ভ্রমণ শুরু করি। সকল ৮.৩০ টায় আমরা হোটেল ত্যাগ করি। ১০ টা বাজে সকালের নাস্তা সম্পূর্ণ। সবাই বাসে উঠে গেলাম। গন্তব্য শ্রীমঙ্গল। দুপুর ১২ টা বাজতেই পৌঁছে যাই মাধবপুর লেকে।
মাধবপুর লেক
চারদিকে গাঢ় সবুজ পাহাড়। উপরে খোলা আকাশ, নেই কালো ধোয়া কিংবা ইট-পাথরের জঞ্জাল। শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো মনোরম চা বাগানের দৃশ্যে চারদিকে। সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত বিশালতায় পরিপূর্ণ জলরাশি। লেকে ঝলমলে স্বচ্ছ পানি, ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ, শাপলা-শালুকের উপস্থিতি আরো মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে পরিবেশ। এই অপরূপ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ লেকটির অবস্থান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নে। মাধবপুর লেকের সৌন্দর্যে বিমোহিত হই আমরা।দেখতে দেখতে মাথার উপরের সূর্য জানান দিচ্ছে দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে। আমরা 'গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট ও গলফ 'এর সামনের রেস্টুরেন্টে থেকে দুপুরের খাবার খাই। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
চা বাগানের রাস্তা ধরে এগিয়ে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। শ্রীমঙ্গল আর কমলগঞ্জ উপজেলা মিলে ১২৫০ হেক্টর জায়গা জুড়ে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এই বন। টিকিট কেটে উদ্যানের ভেতরে ঢুকে দেখা মিলে আকাশ ছেয়ে যাওয়া বিশাল সব বৃক্ষরাজির। জঙ্গলের কিছু কিছু জায়গায় গাছের ছায়া ভেদ করে পৌঁছাতে পারে না রোদ। এখানকার কোনো কোনো গাছ লাগানো হয়েছিল সেই ব্রিটিশ আমলে। কিছুদূর এগোতেই দেখা মিলে বিলুপ্ত সব প্রাণীর সাইনবোর্ড। বিচিত্র আর অচেনা গাছের ফাঁক থেকে নানা পাখির ডাকও ভেসে আসছিল আমাদের কানে। জনমানুষের কোলাহলের বাইরে পশুপাখির এই অভয়ারণ্যে নিজেদের পথচলার শব্দটাও ছিল বেমানান। লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। সবুজের সমারোহে অপরূপ সৌন্দর্য এই রেলপথকেও করে তুলেছে অনন্য। ফরাসি লেখক জুলভার্নের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হলিউডের সিনেমা "অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ" ও হুমায়ূন আহমেদের সিনেমা "আমার আছে জল"র দৃশ্যের শ্যুটিং হয়েছিল এই রেললাইনে। চিরহরিৎ এই বনে হঠাৎই সন্ধ্যা নেমে আসে। আমরা দ্রুত বন ত্যাগ করি। এখান থেকে ফিরে রাতের খাবার খাওয়ার মাধ্যমে আমাদের ট্যুরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। এরপর আমরা বাসে উঠে নোয়াখালীর উদ্দেশে রওনা হই। প্রায় ৯ ঘণ্টা জার্নি শেষে ভোর সকালে নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসে ফিরে আসার মাধ্যমে স্মৃতিময় ট্যুরের সমাপ্তি ঘটে।
এসজে/আরইউ